চলছে লুকোচুরি খেলা

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন

*অলিতে-গলিতে আড্ডা, স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই
*রাজধানীতে বেড়েছে মানুষের চলাচল
*ব্যাংক খোলা হলেও গ্রাহক নেই ব্যাংকে

 

বিশেষ প্রতিবেদক : দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সরকারঘোষিত সর্বাত্মক লকডাউনের পঞ্চম দিনে সোমবার রাজধানীতে নানা অজুহাতে লোক চলাচল অনেক বেড়েছে। অলিতে-গলিতে চলছে আড্ডা। স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই।
বিশেষ করে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান, রাস্তার মোড়ে অপ্রয়োজনে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে মানুষজনকে। খোলা রয়েছে প্রজ্ঞাপনে বন্ধ রাখতে বলা চায়ের দোকান, সেলুন, হার্ডওয়্যারসহ বিভিন্ন দোকানপাট। প্রধান সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি দেখামাত্র ঝপাঝপ দোকান বন্ধ করে সটকে পড়ছে গলির ভেতর। লোকজন দৌড়ে আড়ালে সরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আবার বের হয়ে মেতে উঠছে আড্ডায়। সোমবার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এ চিত্র দেখা যায়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, ধলপুর, মানিকনগর, মুগদা, মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ, ঢাকা উদ্যান, নবোদয় হাউজিং, নবীনগর হাউজিংসহ বিভিন্ন এলাকার সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কঠোর বিধিনিষেধের (লকডাউন) তোয়াক্কা না করে অবাধে চলাফেরা করছে মানুষ। মানা হচ্ছে না কোনো স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব। সরকারের দেয়া প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী জরুরি পরিষেবা ব্যতীত সব দোকানপাট বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও খোলা রাখা হয়েছে সব ধরনের দোকানপাট।
এদিকে সোমবার সকাল থেকে মানিকনগর এলাকায় রাস্তার মোরে মোরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের জনসচেতনতায় কাজ করতে দেখা গেছে। মানিকনগরের আবুল বাশার বলেন, কঠোর বিধি নিষেধ অমান্য করে বাজারের বেশীর ভাগ দোকান পাট খোলা ছিলো। সোমবার সেনাবাহিনী আশায় তারা দোকান পাট বন্ধ করে অলি-গলিতে আড্ডা দিচ্ছে। এ ভাবে লুকোচুরি খেললে করোনা ভয়াবহতা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।
এদিকে প্রজ্ঞাপনে খাবারের দোকান খোলা থাকলেও সেখানে বসে খাবার খাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও কেউই মানছেন না সে নিয়ম। সাধারণত খেটে খাওয়া দিনমজুর শ্রেণির মানুষেরা ভিড় করছেন হোটেলগুলোতে। অলি-গলিতে চায়ের দোকানে চলছে আড্ডা। বেশিরভাগ মানুষের মুখেই থাকছে না মাস্ক। বেড়েছে রাস্তাঘাটে মানুষের চলাফেরা। সেইসঙ্গে নিজস্ব পরিবহন ও রিকশার চাপ চোখে পড়ার মতো। ভ্যানের উপর চলছে সবজি ও নানান ফল বিক্রি আর সেখানেও ভিড় জমাচ্ছেন মানুষ। মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব।
খোলা রয়েছে জরুরি সেবার বাইরে থাকা সেলুন, হার্ডওয়্যার, ইলেকট্রনিক, ভাঙ্গারি দোকান, টেইলার্স, লন্ড্রিসহ বিভিন্ন দোকান।
কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর চোখ ফাকি দিতে চলছে পাহারা। অনেক দোকানের এক সাটার খোলা, আবার অনেক সাটার নামিয়ে ভেতরে একজন বাইরে একজন দাঁড়িয়ে কেনাবেচা করছেন। পাশাপাশি পুলিশ আসছে কিনা সেটিও দেখছেন। পুলিশের গাড়ি আসলে বাইরে থাকা ব্যক্তি দোকানের সাটারে তালা লাগিয়ে সটকে পড়ছেন। এভাবেই দিনভর চলছে লুকোচুরি খেলা।
এদিকে মহামারি করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সরকার ঘোষিত ৭ দিনব্যাপী কঠোর বিধিনিষেধের পঞ্চম দিন ছিলো সোমবার। প্রথম দুই দিন রাস্তা ফাঁকা থাকলেও শনিবার থেকেই সড়কে মানুষ ও যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পঞ্চম দিনেও তা অব্যাহত আছে। সোমবার সড়কে মানুষ ও যানবাহনের পাশাপাশি রিকশার উপস্থিতি বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও বেশ কিছু অফিস খোলা রয়েছে, আর মূলত সেইসব অফিসগামীদের কারণেই সড়কে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
সরেজমিনে রাজধানীর প্রগতি সরণি, রামপুরা, মালিবাগ, গুলশান, বাড্ডা, কুড়িল বিশ্বরোড, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, তালতলা, শ্যামলী, কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুর ও ফার্মগেট ঘুরে দেখা যায়, রোববাের তুলনায় সোমবার সড়কে মানুষের চলাচল বেশি। পাশাপাশি বেড়েছে রিকশাসহ ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা। এলাকা ঘুরে দেখে গেছে, আগের চারদিনের তুলনায় সড়কে মানুষ, রিকশা, যানবাহন অনেক বেড়েছে। শুধু চলছে না গণপরিবহন। এছাড়া সব কিছুই চলছে। তবে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম।
জরুরি প্রয়োজনে অনেকে বের হয়েছেন। পুলিশ বিভিন্ন চেকপোস্টে মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এছাড়াও শিল্পকারখানা, ব্যাংক, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রতিষ্ঠানের যানবাহনে অথবা পরিচয়পত্র নিয়ে বের হতে দেখা গেছে।
তবে প্রধান সড়কে পাশের রিকশার জটলা দেখা গেছে। রিকশায় করে নগরবাসী তাদের গন্তব্যে যাচ্ছেন। সোমবার থেকে ব্যাংক খোলা। তাই প্রয়োজনীয় লেনদেন করতে নগরবাসী বাইরে বের হয়েছেন। রাস্তায় গণপরিবহন না থাকায় রিকশা কিংবা পায়ে হেঁটে চলাচল করছেন অনেকেই।
রাজধানীর কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে বিধিনিষেধের মধ্যে অকারণে বের হওয়া ঠেকাতে চেকপোস্ট বসিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানভির ফরহাদ শামিম।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিগত দিনের তুলনায় সোমবার অনেকটাই মানুষের চাপ বেড়েছে। আমরা যাকেই চেক করতে যাচ্ছি কোন না কোন অজুহাত দেখাচ্ছে। বিশেষ করে চারদিন পর ব্যাংক খোলায় অনেকেই বিভিন্ন লেনদেনের জন্য ব্যাংকমুখী। এছাড়া হাসপাতালে যাবে বলে অনেকে কাগজ দেখাচ্ছে। আমরা বৈধ কাগজ থাকলেই কেবল যেতে দিচ্ছি। তবে যখন চেক করতে যাচ্ছি তখন একটা বিষয় লক্ষ্য করছি অনেকেই বিভিন্ন কোম্পানির নামে জরুরি কাগজ দেখাতে চাচ্ছে। গাড়িতে বিভিন্ন স্টিকার ও ব্যানার রেখে জরুরি সেবা বলে অজুহাত দেখাচ্ছে।’
মাতুয়াইল মেডিকেল থেকে রাজারবাগ যাওয়ার জন্য সড়কে অপেক্ষা করছিলেন নাজমুল হাসান নাসিম নামে একজন সরকারি চাকরিজীবী।
তিনি বলেন, গত তিন দিনের তুলনায় সোমবার মানুষ, যানবাহন, রিকশার সংখ্যা সড়কে অনেক বেশি। প্রথম তিনদিন ভালোভাবে লকডাউন পালিত হয়েছে, কিন্তু রোববার থেকে এই সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। সোমবার থেকে যেহেতু ব্যাংক খুলেছে তাই মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে। এছাড়া আমাদের মতো জরুরি সেবা প্রদানের অফিসগুলো খোলা আছে আগে থেকেই। এসব অফিস-গামী মানুষরা সকাল সকাল সড়কে ভিড় করেছেন।
কঠোর বিধিনিষেধ কেমন চলছে জানতে চাইলে রিকশাচালক গাজী সাঈদ জুম্মন বলেন, মানুষ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে যানবাহনের সংখ্যাও। ট্রিপ না পাওয়ায় রিকশাও কম চলতো এই কয়দিন। কিন্তু রোববার ও সোমবার সড়কে রিকশা অনেক বেড়েছে।
ব্যাংক খোলা হলেও গ্রাহক নেই ব্যাংকে : করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রকোপ ঠেকাতে সরকারের দেওয়া সাতদিনের ‘সর্বাত্মক লকডাউনের’ মধ্যে টানা চারদিন পর ব্যাংক খোলা হলেও গ্রাহক নেই ব্যাংকে। ব্যাংকগুলোর প্রায় প্রতিটি কাউন্টারই ছিল ফাঁকা। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বাত্মক বিধিনিষেধের আগেই অধিকাংশ গ্রাহক লেনদেন সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া গণপরিবহন বন্ধ ও জনসাধারণ চলাচলে কড়াকড়ি থাকায় অনেকে আসছেন না।
প্রসঙ্গত, লকডাউনে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার, শনিবারের সঙ্গে রবিবারও বন্ধ ছিল ব্যাংক। এছাড়া বৃহস্পতিবার ছিল ব্যাংক হলিডে।
এদিকে সোমবার থেকে ব্যাংকে লেনদেনের সময়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর আগে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত লেনদেন চললেও সোমবার থেকে ব্যাংকগুলো সকাল ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। আর আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সাড়ে ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকবে ব্যাংক।
সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি ব্যাংক ঘুরে দেখা গেছে, এদিন সকাল থেকে ব্যাংকের শাখা খোলা হলেও ব্যাংকে গ্রাহকের উপস্থিতি তেমন নেই। যারা ব্যাংকমুখী হচ্ছেন তাদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন বিল জমা দিতে এসেছেন। একই চিত্র দেখা গেছে অন্যান্য শাখায়। অন্যদিকে মতিঝিলে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে গ্রাহকের উপস্থিতি থাকলেও তা অন্যদিনের তুলনায় কম।
এর আগে গত ২৬ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অব সাইট সুপারভিশন থেকে এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অত্যাবশ্যকীয় বিভাগসমূহ, যথাসম্ভব সীমিত লোকবলের মাধ্যমে খোলা রাখতে হবে। ব্যাংকের প্রিন্সিপ্যাল বা প্রধান শাখা এবং সকল বৈদেশিক বাণিজ্য শাখা (এডি শাখা) সীমিত সংখ্যক অত্যাবশ্যকীয় লোকবলের মাধ্যমে খোলা রাখতে হবে।’
এতে আরও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকসমূহের ক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা বিবেচনায় প্রতিটি জেলা সদর ও উপজেলায় একটি করে শাখা খোলা রাখা যাবে। আর অন্যান্য সকল ব্যাংকের ক্ষেত্রে জেলা সদরে একটি শাখা খোলা রাখতে হবে এবং জেলা সদরের বাইরে ব্যাংক ব্যবস্থপনায় অনধিক দুটি শাখা খোলা রাখা যাবে। কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংসেবা সার্বক্ষণিক চালু রাখতে হবে। এটিএম বুথে পর্যাপ্ত নোট সরবরাহসহ সার্বক্ষণিক চালু রাখতে হবে।


বিজ্ঞাপন