গাইবান্ধাকে আমরাই হত্যা করেছি!

বিবিধ

মশিয়ার খান : ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত গাইবান্ধা শুধু একটি মহুকুমা শহরই ছিল না,ব্যবসা- বাণিজ্যেও তার সুখ্যাতি ছিল প্রচুর।


বিজ্ঞাপন

ভাল নৌ ও রেল যোগাযোগ থাকায় এখানকার ব্যবসায়ীরা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়নগঞ্জসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন মোকাম থেকে নৌ ও রেল পথে সস্তায় মালামাল নিয়ে আসতো; আবার সে মালামাল বিক্রি করতো বগুড়া, রংপুরসহ উত্তরবংগের প্রায় সব এলাকায়। উত্তরবংগের একটি জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র ছিল গাইবান্ধা। কিন্তু ষাটের দশকের শুরু থেকেই গাইবান্ধার ব্যবসা-বাণিজ্যে ধ্বস নামা শুরু করে।

কিন্তু প্রশ্ন এসে যায়, এটা কি অন্য কোন ব্যবসা কেন্দ্রের অগ্রগতির জন্য? গাইবান্ধার ব্যবসায়ীদের ব্যর্থতার জন্য? না কি অন্য কোন কারনে তা আজ খতিয়ে দেখা দরকার।

আর খতিয়ে দেখলে প্রতীয়মান হবে সরকারি প্রকল্প গ্রহন এবং গাইবান্ধাবাসির প্রতিরোধহীন সমর্থন মিলে গাইবান্ধাকে হত্যা (?) করা হয়েছে।1

গাইবান্ধা শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত ঘাঘট নদী ছিল গাইবান্ধার ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল স্তম্ভ।

এই নদী জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলায় প্রবেশ করে গাইবান্ধা শহরের উপর দিয়ে প্রায় ১০ মেইল ভাটিতে ব্রহ্মপুত্র নদে পড়েছিল।

ফলে ব্রহ্মপুত্র হয়ে পণ্য বোঝাই বিশাল বিশাল নৌকা ঘাঘট হয়ে গাইবান্ধায় আসতো এবং এখান থেকেও পণ্য নিয়ে চলে যেতো। এ ছাড়া রেল যোগাযোগ ছিল চলাচল ও পণ্য পরিবহণের একটি শক্তিশালী সস্তা মাধ্যম।

গাইবান্ধা রেল স্টেশনে প্রতিদিন শত শত ওয়াগনে মাল বোঝাই ও খালাস হতো। পণ্য পরিবহণে এই দুই পথ ব্যবহার করে গাইবান্ধা ব্যবসা-বানিজ্যে ফুলেফেপে উঠেছিল।

এক সময় আমরাই ব্যবসা-বাণিজ্যে রমরমা গাইবান্ধাকে হত্যার(?) জন্য উঠেপড়ে লাগলাম।

এবং আমাদের কোনো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ছাড়াই কয়েকটি সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা এক সময়ের ব্যবসা -বাণিজ্যে জমজমাট গাইবান্ধাকে হত্যার(?) কাজটি সুসম্পন্ন করে ফেললাম।।

ষাটের দশকের শুরুর দিকে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক নির্মান কাজ শুরু হয়। সড়কটি ঢাকা থেকে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় প্রবেশ করে গাইবান্ধা শহর স্পর্শ না করে পলাশবাড়ীর উপর দিয়ে রংপুরে সংযোগ দেওয়া হয়।

মহাসড়ক হারিয়ে গাইবান্ধার ভাগ্যে ধীরে ধীরে নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম সড়ক পথ থেকে গাইবান্ধা বিচ্যুত হয়ে পড়ে।

পণ্য ও যাত্রী পরিবহণ যতই বাড়তে থাকে গাইবান্ধা ততই পিছিয়ে পড়তে থাকে। গাইবান্ধা একটি ” পকেট” শহরে পরিণত হয়ে পিছিয়ে পড়ে।

শোনা যায়,তখনকার জাতীয় পরিষদ সদস্য শ্রদ্ধেয় আব্দুল আউয়াল খান নাকি মহাসড়কটি গাইবান্ধা শহরের উপর দিয়ে করার বিরোধীতা করেছেন এই বলে যে, এতে এখানে দুধ, ডিমসহ অন্যান্য জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি ঘটবে। প্রথম দিকে নাহলেও কয়েক বছরের মধ্যে আমরা বুঝতে পারলাম আমরা কি সর্বনাশের সম্মুখিন হয়েছি।

যোগাযোগ ও পরিবহণ মাধ্যম যতই সড়কমুখি হচ্ছিল গাইবান্ধা ততই সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল।

মহাসড়ক দূর দিয়ে সরিয়ে দিয়েই আমরা ক্ষান্ত হলাম না। কারন তখনও নৌপথ ও রেল পথ অটুট ছিল। আমরা এবার নৌপথ রুদ্ধ করার দিকে নজর দিলাম।

ঘাঘট দিয়ে গাইবান্ধায় ব্যবসা-বাণিজ্যের নৌকা প্রবেশ করতো–সে পথ বন্ধ করার উপায় খুঁজতে লাগলাম। তৎকালিন ওয়াপদা এগিয়ে এলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।

ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের কার্যকারিতা “পোক্ত” করার জন্য ঘাঘট নদীর উপর স্লুইস গেট নির্মাণের ব্যবস্থা করা হল। যাতে নৌপথ দিয়েও গাইবান্ধায় ব্যবসা- বাণিজ্য হতে না পারে।

ওয়াপদা১৯৬৭ সালের দিকে ঘাঘট নদীর ভাটিতে স্লুইস গেট নির্মাণ করল বন্যা ঠেকানোর নামে। ফলে ব্রহ্মপুত্রের সাথে ঘাঘট হয়ে গাইবান্ধার নৌ চলাচল একদম বন্ধ হয়ে গেল। এই দ্বিতীয় কোপে গাইবান্ধার ব্যবসা- বাণিজ্য একদম ঠান্ডা হয়ে গেল।

মোটামুটি নিশ্চিৎ হলো গাইবান্ধার মৃত্যু। আমরা আনন্দিত হলাম । দলে দলে স্লুইস গেটদর্শনে ছুটলাম তীর্থ দর্শনের মতো।

রেল যোগাযোগের বিষয়টি অবশ্য গাইবান্ধাবাসীর কাছ থেকে সরকারই নিজ কাঁধে তুলে নেয়। ওয়াগন ভেংগে মালামাল লুট, পণ্য উঠানামায় কুলিদের দৌরাত্ম, সর্বোপরি পরিবহণে অনেক বেশি সময় লাগা – ইত্যাদি কারনে ব্যবসায়ীরা রেল বিমুখ হয়ে উঠে।

ফলে সস্তায় পরিবহণ করা গেলেও, সস্তার তিন অবস্থা, দেখে ব্যবসায়ীরা রেলকে ত্যাজ্য করে। এসব করে সরকারই রেলকে ধ্বংস করার ফলে গাইবান্ধাবাসীকে আর আলাদা করে ভূমিকা রাখতে হয়নি।

তবে তার ফল আমরা পেয়েছি। সস্তায় পণ্য আনা নেয়ার এ পথটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাইবান্ধার মৃত্যু ত্বরাণ্বিত হয়।

গাইবান্ধার দুর্ভাগ্য, গাইবান্ধার উন্নয়নে নেতৃবৃন্দ সবসময় সরকারি কর্মকর্তাদের উপর নির্ভরশীল।

তারা যে প্রকল্প প্রণয়ন করেন নেতৃবৃন্দ সে প্রকল্পই মেনে নেন। গাইবান্ধার স্বার্থেও যে প্রকল্প পরিবর্তন করা হতে পারে সে জ্ঞান কিংবা সাহসটুকু তারা দেখাতে পারেন না।

যে গাইবান্ধাকে আমরা নিজেরাই হত্যা করেছি সে গাইবান্ধা অন্য কোন উন্নয়নের মাধ্যমে আদৌ তার প্রাণ ফিরে পাবে কি?