ফ্ল্যাট ক্যাসিনো

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় রাজধানী

নজরদারীতে বেইলি রোড-গুলশান-বনানী এলাকা
ক্লাব পাড়ার ক্যাসিনো বাণিজ্যে ক্ষুব্ধ ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী
নেপালিদের পালাতে সহায়তাকারীর পরিচয় ‘শনাক্ত’

মহসীন আহমেদ স্বপন : রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবের পাশাপাশি অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাটেও ক্যাসিনো স্থাপন করা হয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব ক্যাসিনো পরিচালনা করছেন কয়েকজন নেপালি ব্যবসায়ী। পাশাপাশি নেপাল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা কয়েকজন বাংলাদেশি যুবকও এগুলোতে কাজ করেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সংস্থা বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তারা ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি তালিকা তৈরি করে ফ্ল্যাটগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি করছেন।
এদিকে ক্লাব পাড়ার ক্যাসিনো বাণিজ্যকে ন্যাক্কারজনক ও জঘন্য উল্লেখ করে ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি বলেছেন, এই অবৈধ কাজের সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের কঠোর শস্তি হওয়া উচিত। অপরাধী কাউকে যেন ছাড় দেয়া না হয়।
অন্যদিকে রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলার সময় সেগুনবাগিচার একটি ভবন থেকে ১৫ নেপালিকে পুলিশ পরিচয়ে পালাতে সহায়তাকারী তিনজনের একজনকে ‘শনাক্ত’ করা হয়েছে। ওই ব্যক্তি রমনা থানার কনস্টেবল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
‘টেন্ডার কিং’ জি কে শামীম র‌্যাবের হাতে ধরা পর থেকেই সামনে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। যার ধাক্কা লেগেছে মিডিয়া পাড়াতেও। একটি জাতীয় দৈনিক উঠে আসে শোবিজের অনেকের সঙ্গে শামীমের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ।
অভিযোগ, টেন্ডার বাগিয়ে নিতে অনেক উঠতি নায়িকা থেকে শুরু করে মডেলদের ব্যবহার করতে টেন্ডার মাফিয়া জি কে শামীম। খবরে বলা হয়, জিজ্ঞাসাবাদে জি কে শামীম ও যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ডিবি পুলিশের কাছে এসব তথ্য স্বীকার করেছেন।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, তারা ঢাকার অভিজাত এলাকার ২১টি ফ্ল্যাটে ক্যাসিনো চলার তথ্য পেয়েছেন। শিগগিরই সেখানে অভিযান চালানো হবে। এগুলো পরিচালনা করেন কয়েকজন নেপালি। যাদের কেউ কেউ স্টুডেন্ট ভিসা আবার কেউ বাংলাদেশে ঘুরতে আসার ভিসা নিয়ে এসব কাজ করছেন। ফ্ল্যাটের এসব ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের নেতারা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকা অনুযায়ী, রাজধানীর বেইলি রোডের ৩টি ফ্ল্যাটে, গুলশানে ১টি, বনানীতে ১০টি ও উত্তরায় ৭টি ফ্ল্যাটে অবৈধ ক্যাসিনোর ব্যবসা রয়েছে।
সূত্র জানায়, বেইলি রোডের ক্যাসিনো তিনটির নিয়ন্ত্রক ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে আহমেদ টাওয়ার, সুইট ড্রিমসের ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদত হোসেন ওরফে সেলিম।
এছাড়া উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের পূবালী ব্যাংকের দোতলায় ক্যাসিনো চালাচ্ছেন উত্তরা পশ্চিম থানা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী জাকারিয়া। এসব এলাকার ভবনের ফ্ল্যাটগুলো অনেক নিরাপদ, সেখানে অপরিচিত কেউ ঢুকতে পারে না। তাই এসব ফ্ল্যাটে ক্যাসিনো স্থাপনকে নিরাপদ বলে মনে করে এগুলোতে ক্যাসিনো স্থাপন করা হয়েছে। তবে তাদের তিনজনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার-বিন-কাশেম বলেন, র‌্যাব বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। যদি ক্লাবের পাশাপাশি এসব এলাকার ফ্ল্যাটে কোনো ধরনের ক্যাসিনো থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে র‌্যাব।
আরেকটি সূত্র জানায়, গত ১৮ সেপ্টেম্বর র‌্যাব যখন প্রথমবারের মতো চারটি ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযান চালায়, তখনই এসব ক্যাসিনোর নেপালিরা গা ঢাকা দেয়। আর তাদের গা ঢাকা দিতে সহায়তা করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুজন সদস্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আসা একটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ অনুযায়ী সেদিন রাতে সেগুনবাগিচার একটি বাসায় অবস্থান করছিল নেপালিরা। দুজন ওয়াকিটকি হাতে এসে বাড়িটি থেকে তাদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যায়।
দুজনকেই শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের একজন একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদর দফতরের সহকারী প্রোগ্রামার, আরেকজন একই সংস্থার রমনা জোনের কনস্টেবল সমমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। দুজনের বিরুদ্ধেই বিভাগীয় তদন্ত চলছে।
এদিকে ক্যাসিনো পরিচালনাকারী নেপালিদের পালাতে সহায়তাকারী হিসেবে কয়েকজন পুলিশ সদস্য জড়িত আছে বলে জানা গেছে।
তবে এ বিষয়ে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, নেপালিদের আত্মগোপনের বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন টিম কাজ শুরু করেছে। সিসিটিভির ছবি পরীক্ষা করে ওয়াকিটকি হাতে থাকা ওই ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা অব্যাহত আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ওয়াকিটকি শুধু পুলিশ সদস্যরাই ব্যবহার করে না। পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত সদস্য, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরাও ওয়াকিটকি ব্যবহার করে থাকে। সত্যতা নিশ্চিত না হয়ে পুলিশ সদস্য বলে প্রচার না করতে অনুরোধ জানান তিনি।
ক্লাব পাড়ার ক্যাসিনো বাণিজ্যে ক্ষুব্ধ ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী : ক্লাব পাড়ার ক্যাসিনো বাণিজ্যকে ন্যাক্কারজনক ও জঘন্য উল্লেখ করে ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি বলেছেন, ‘এই অবৈধ কাজের সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের কঠোর শস্তি হওয়া উচিত। অপরাধী কাউকে যেন ছাড় দেয়া না হয়। সে যেই হোক।
যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী রাগবি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আয়োজকদের বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে জাপান গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে তিনি ক্যাসিনোর বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘স্পোর্টস ক্লাবগুলোর প্রধান কাজ হলো খেলাধুলায় সক্রিয় থাকা। কিন্তু স্পোর্টসের নাম ভাঙিয়ে ক্লাবগুলোতে অবৈধভাবে জুয়া ও ক্যাসিনো বাণিজ্য হয়েছে। এর চেয়ে ন্যাক্কারজনক ও জঘন্য কাজ আর হতে পারে না। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এসব অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়া হচ্ছে। আমি চাই যারা খেলাধুলার জায়গা ক্লাব পাড়ায় এই অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য করেছে তাদের যথাযথ বিচার হোক।
ক্লাবগুলো থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই একটি গোষ্ঠি ক্যাসিনো পরিচালনা করতো। এ প্রসঙ্গে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বলেন, তার জবাব ক্লাবগুলো দেবে। তবে জোর করে ক্যাসিনো চালানোর বিরুদ্ধে ক্লাবগুলো কেন আইনের আশ্রয় নেয়নি? কেন তারা থানায় মামলা বা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেনি। ক্লাবের মধ্যে অবৈধ ক্যাসিনো আর জুয়ার কারণে ক্রীড়াঙ্গনের সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে।
আমার একটাই কথা, এই অবৈধ কার্যকলাপের সঙ্গে যেই জড়িত থাকা কাউকে যেন ছাড় দেয়া না হয়। তাদের চিহ্নিত করে যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপকর্ম করার সাহস কেউ না পায়। যারা এ কাজ করেছে, তারা যেই হোক তা বিবেচ্য নয়। যত বড় নেতা, প্রশাসনের ব্যক্তি কিংবা ক্লাব কর্মকর্তা হোক তাদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে-বলেছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি।
ক্লাবগুলোর জন্য এই জায়গা তো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) বরাদ্দ দিয়েছিল আশির দশকের শেষ দিকে। ক্লাবগুলোর কার্যক্রমের ওপর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মনিটরিং ব্যবস্থা ছিল কিনা এবং এ ঘটনার পর সেটা করা হবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ক্লাবগুলোকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ জায়গা দিয়েছে ঠিক। কিন্তু ক্লাবগুলোর কার্যক্রম মনিটরিং করা কিংবা জবাবদিহিতার মধ্যে আনার সুযোগ এনএসসির নেই। কারণ, এই ক্লাবগুলো আমাদের কাছ থেকে রেজিষ্ট্রেশন নেয়নি, আমরা তাদের কোনো বরাদ্দও দেই না। ক্লাবগুলো শুধু ক্রীড়ার কার্যক্রমই করে না, তারা নানা ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমও করে থাকে। এগুলোর রেজিষ্ট্রেশনের বিষয় সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হাতে এবং তারা বিভিন্ন খেলায় অংশ নেয় ফেডারেশনগুলোর অধীনে। তাই তাদের কোনো কার্যক্রম আর আয়-ব্যয় পর্যবেক্ষণের সুযোগ আমাদের নেই।
ফেডারেশনগুলো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিবন্ধিত। যে কারণে, আমরা কিন্তু তাদের মাঝে-মধ্যেই বিভিন্ন নির্দেশনা দেই। তাদের কার্যক্রমের জবাবদিহিতা নেই। তেমন চাইলে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং ফেডারেশন তাদের তাদের অধিভুক্ত ক্লাবগুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে পারে। আর অবৈধ যে কার্যকলাপ হয়েছে তার বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। সরকার এ বিষয়ে কঠোর। কাউকেই ছাড় দেবে না-বলেছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী।
নেপালিদের পালাতে সহায়তাকারীর পরিচয় ‘শনাক্ত’ : রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলার সময় সেগুনবাগিচার একটি ভবন থেকে ১৫ নেপালিকে পুলিশ পরিচয়ে পালাতে সহায়তাকারী তিনজনের একজনকে ‘শনাক্ত’ করা হয়েছে। ওই ব্যক্তি রমনা থানার কনস্টেবল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
নেপালিদের পালাতে সহায়তা করার বিষয়টি পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) তদন্ত করছে বলে জানিয়ে রমনা অঞ্চলের উপ-কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান বলেন, আমরা জানতে পেরেছি তাদের একজন রমনা থানার কনস্টেবল দিপঙ্কর চাকমা। তিনি ছুটিতে ছিলেন এবং ছুটির পর তিনি থানায় যোগ দেননি। এ কারণে তাকে সাসপেন্ড করে কর্তৃপক্ষ।
তিনি আরও বলেন, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। যদিও অনেকেই বলেছে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাওয়া ব্যক্তি দিপঙ্কর, তবে তিনি অফিসে না আসা পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে এটা বলা যাবে না।
প্রসঙ্গত, ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ফকিরাপুলের ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র এবং বনানীর গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওইদিনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১০টা ৩৯ মিনিটে সেগুনবাগিচার সামিট হাসান লজ ভবনে পুলিশ পরিচয়ে প্রবেশ করেন তিন ব্যক্তি। তাদের পরনে পুলিশের পোশাক না থাকলেও, কাছে ওয়াকিটকি ছিল।
ভবন ত্যাগের আগে তারা সেখানে ৫০ মিনিট মতো অবস্থান করেন। যাওয়ার সময় তাদের একজনের হাতে একটি ব্যাগ ছিল বলে দেখা যায় সিসিটিভি ফুটেজে। এর কিছুক্ষণ পরেই ওই ভবনে থাকা ১৫ নেপালিকে ভবন থেকে বের হতে দেখা যায়।


বিজ্ঞাপন
👁️ 21 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *