
অঞ্চল-৫ এ সহকারী কর কমিশনার জান্নাতুল ফেরদৌস মিতু।

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থা গত দুই দশক ধরে বারবার দুর্নীতি, ঘুষ এবং অদক্ষতার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আসছে। সর্বশেষ কর অঞ্চল-৫ এ সহকারী কর কমিশনার জান্নাতুল ফেরদৌস মিতুকে নিয়ে কোটি টাকার ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা আসলে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—বরং রাজস্ব বোর্ডের দীর্ঘদিনের অদূরদর্শীতা ও কাস্টমস অফিসের গভীর অনিয়মেরই বহিঃপ্রকাশ।
কর অঞ্চল-৫ এর সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারি : এসএ গ্রুপ ও এসএ পরিবহনের কর্ণধার সালাহ উদ্দিন আহমেদ ১২ করবর্ষের কর ফাইল সাজাতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকির ফন্দি আঁটেন। তার আয়কর আইনজীবী ওবায়দুল হক সরকার সরাসরি কর অঞ্চল-৫ এর সহকারী কর কমিশনার মিতুর সঙ্গে ১ কোটি টাকার ঘুষচুক্তি করেন। প্রমাণ হিসেবে ৩৮ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনও দুদকের হাতে এসেছে।

এই অর্থের বিনিময়ে করদাতার পুরোনো রিটার্ন পরিবর্তন করে সেখানে ২৩৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা আয় করমুক্ত খাত দেখিয়ে যোগ করা হয়। অথচ এই করদাতা আপিল, ট্রাইব্যুনাল এবং হাইকোর্টে গিয়েও সুবিধা পাননি। কেবল ঘুষের জোরেই রাষ্ট্রীয় রাজস্ব লুটের ব্যবস্থা করা হলো।

দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযানে গিয়ে নথিপত্র উদ্ধার করে এবং প্রাথমিক যাচাইয়ে অভিযোগের সত্যতা মেলে। ইতিমধ্যেই মিতুকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং করদাতা ও তার আইনজীবীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
কাস্টমস অফিসের পুরনো রোগ : এনবিআরের কাস্টমস শাখার দুর্নীতির ইতিহাস দীর্ঘ। চট্টগ্রাম কাস্টমসে বারবার দেখা গেছে আমদানি করা পণ্য গায়েব হয়ে যাওয়া কিংবা বন্ড সুবিধা ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি। সম্প্রতি ৯২৬ টন কাপড় আমদানির হদিস মিলেনি, যা কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির প্রমাণ দেয়। ইপিজেড বন্দর সিন্ডিকেট কৌশলে পণ্য পাচার করেছে বছরের পর বছর, স্থানীয় প্রভাবশালী ও অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে।আজিমপুর সরকারি কলোনির পার্কিং প্রকল্পে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা কোটি কোটি টাকা লুট করেছেন—যেখানে টেকনিক্যাল ভুলের আড়ালে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দুর্নীতি বৈধতা পেয়েছে। ওয়ালটন লিফট টেন্ডার কেলেঙ্কারিতেও দেখা গেছে কাস্টমস-গণপূর্তের কর্মকর্তাদের সরাসরি স্বার্থসংশ্লিষ্টতা।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে, কাস্টমস ও কর কর্মকর্তাদের সক্রিয় যোগসাজশ ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী কিংবা শিল্পগোষ্ঠী বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিতে পারে না।
এনবিআরের অদক্ষতা ও অদূরদর্শীতা : এনবিআরের সমস্যা মূলত তিনটি স্তরে— স্তর তিনটি যথাক্রমে—–
অভ্যন্তরীণ নজরদারির অভাব: কোটি কোটি টাকার রিটার্নে হঠাৎ অঙ্ক বদলালেও কোনো ‘অ্যালার্ট’ ব্যবস্থা নেই। কর্মকর্তারা চাইলে পুরোনো ফাইল নিজের চেম্বারে নিয়ে গিয়ে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করতে পারেন।
রাজনৈতিক ছত্রছায়া : দুর্নীতিতে ধরা পড়া কর্মকর্তাদের অনেককে কেবল সাময়িক বরখাস্ত করা হয়, পরে তারা অন্য জায়গায় পদোন্নতিও পান। ফলে দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
অদূরদর্শীতা: রাজস্ব ঘাটতির দায় সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো হলেও বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর করফাঁকি রোধে দৃশ্যমান কোনো কৌশল নেয়নি এনবিআর। ফলে বৈষম্য বেড়েই চলেছে।
দুদকের হাইলাইটস-আশার আলো : এই প্রেক্ষাপটে **দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)**ই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা অন্তত সাম্প্রতিক সময়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়েছে।কর অঞ্চল-৫ এ অভিযান চালিয়ে সরাসরি নথি উদ্ধার করা। ঘুষের অঙ্ক ও রিটার্ন পরিবর্তনের প্রমাণ সংগ্রহ করা। অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা।
এগুলো প্রমাণ করে, যথেষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আইনি স্বাধীনতা পেলে দুদক এখনো দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম।
উপসংহার : এনবিআরের অদক্ষতা ও কাস্টমস অফিসের দুর্নীতি কেবল রাজস্ব ঘাটতি বাড়াচ্ছে না, বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনআস্থা নষ্ট করছে। সালাহ উদ্দিন–মিতু কেলেঙ্কারি দেখিয়ে দিল—রাষ্ট্রের চোখের সামনে কিভাবে কোটি কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়।
এখন প্রশ্ন হলো—এই ঘটনায় দায় শুধু একজন সহকারী কর কমিশনারের, নাকি গোটা এনবিআরের অদূরদর্শী নীতির?
দুদকের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা এখন আরও বেড়ে গেছে। তারা যদি শক্ত হাতে তদন্ত চালিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে, তবে রাজস্ব ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর যদি এই কেলেঙ্কারি-ও ধামাচাপা পড়ে যায়, তবে রাষ্ট্রীয় রাজস্বের ক্ষতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
