
নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের ওষুধখাতে দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত–বিতর্কিত চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। একদিকে জামানত চেকের বিপরীতে দুই কোটি টাকা চাঁদা দাবি, অন্যদিকে বাজারে মানবহির্ভূত ও নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহ, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি—সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে উঠেছে ভয়াবহ অনিয়ম–দুর্নীতির এক দীর্ঘ ছায়া।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়—ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (DGDA) এখন সরাসরি এই অভিযোগগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বহুবার গুরুতর অভিযোগ ওঠার পরও তাদের কার্যক্রমে কার্যকর নজরদারি ছিল অত্যন্ত দুর্বল। ফলে জনস্বাস্থ্যঝুঁকি মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
জামানত চেকের বিপরীতে দুই কোটি টাকার চাঁদা দাবি—এলবিয়নের চেয়ারম্যান-এমডি-এডভাইজার আদালতে অভিযুক্ত :২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি প্রকাশিত চাঞ্চল্যকর এক প্রতিবেদনে উঠে আসে—ইনোভেটিভ ফার্মার স্বত্বাধিকারী কাজী মোহাম্মদ শহিদুল হাসান এলবিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রাইসুল উদ্দিন, এমডি মোহাম্মদ মুনতাহার উদ্দিন এবং চিফ এডভাইজার মো. নিজাম উদ্দিনের বিরুদ্ধে জামানত চেক ফেরত চাওয়ায় প্রাণনাশের হুমকি ও দুই কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে মামলা (নং ১৫১/২৩, কোতোয়ালি) দায়ের করেন। ঘটনার সারাংশ— ২০১৪ সালে ইনোভেটিভ ফার্মাকে ১০ বছরের পরিবেশক চুক্তি দেয় এলবিয়ন।

লভ্যাংশ বণ্টন—অভিযুক্তদের ৪০%, পরিবেশকের ৬০%। কোনো অবস্থাতেই অন্য পরিবেশক নিয়োগ করা যাবে না—এমন শর্তও ছিল। কিন্তু এলবিয়ন চুক্তি ভঙ্গ করে অন্যান্য পরিবেশক নিয়োগ করে।

২০১৬ সালে ওষুধ প্রশাসন ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে গেলে অভিযুক্তরা কর ফাঁকির অজুহাতে ৫–৬ কোটি টাকার ওষুধ বাদীর গুদামে সরিয়ে নেয়। ওই ওষুধের বিপরীতে তারা তারিখবিহীন ৯টি চেক জামানত রাখতে বলে, যা বাদী সরল বিশ্বাসে দেয়।
বাদীর অভিযোগ— চেক ফেরত চাইলে এলবিয়নের চেয়ারম্যানসহ অভিযুক্তরা বলেন—– “চেক ফেরত চাইলে দুই কোটি টাকা দিতে হবে, নয়তো মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে। প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়।” পিবিআই মামলাটি তদন্ত করছে।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ভয়াবহ বিশ্লেষণ : এলবিয়নের অ্যান্টিবায়োটিকে অ্যামোক্সিসিলিন নেই ! ২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত এক বিস্ফোরক প্রতিবেদনে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (IPH) ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরির বিশ্লেষণ উদ্ধৃত করে বলা হয়—মিমক্স ৫০০ এমজি (অ্যামোক্সিসিলিন) — “অ্যামোক্সিসিলিন একটুও নেই” ব্যাচ নম্বর: ০১১২১২, ক্যাপসুলে পাওয়া গেছে অজানা সাদা দানাদার পাউডার, গড় ওজন: ৩৯০.২ মি.গ্রা।
সরকারিভাবে অভিমত :“ইহা মানবহির্ভূত। অ্যামোক্সিসিলিন শনাক্ত হয়নি।” ইনডোমেথাসিন ক্যাপসুল—ঘাটতি ১০–১৫% পর্যন্ত
দাবিকৃত: ২৫ মি.গ্রা, পাওয়া গেছে: ২৪.১১ মি.গ্রা, ২২.৫৯ মি.গ্রা—দুই ব্যাচেই বড় ধরনের অমিল।
সরকারি বিশ্লেষকের মন্তব্য : “মানবহির্ভূত এবং দাবির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।” একই ভবনে পশুর ওষুধ ও মানুষের ওষুধ উৎপাদন ! DGDA-এর নিয়ম অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়— “এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর ঝুঁকি।”
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (DGDA) কোথায়?—অভিযোগে তীব্র প্রশ্ন : যদিও জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষায় এলবিয়নের ওষুধ মানবহির্ভূত প্রমাণ হয়েছে, DGDA বহু বছর ধরে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি—এমন অভিযোগ রয়েছে।
DGDA-এর কর্মকর্তাদের বক্তব্য : নথি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নাঈম গোলদার—“যথাযথ প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” পরিচালক (প্রশাসন) আশরাফ হোসেন, “নমুনা সংগ্রহ করে নতুন করে আবার পরীক্ষা করা হচ্ছে।” কিন্তু স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন—জাতীয় পরীক্ষাগারে একটি অ্যান্টিবায়োটিকে অ্যামোক্সিসিলিন নেই—এটাই কি যথেষ্ট নয়?
বাজারে দামে ভয়ংকর অসঙ্গতি—কম দামে নিম্নমানের ওষুধ ছড়িয়ে পড়ছে : একই শক্তিমানের ওষুধে— কোম্পানি পাইকারি (১০০ ট্যাবলেট) খুচরা লাভ, বেক্সিমকো/স্কয়ার ৩২০০ টাকা – ৩০০ টাকা, এলবিয়ন ১০৮৩ টাকা ৩০০০ টাকা ১৯১৭ টাকা এভাবে—সেফরাডিন ডি.এস, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, ফ্লুকোনাজল (৫০ এমজি)—যার পাইকারি মূল্য মাত্র ১৬০ টাকা, কিন্তু বিক্রি ৮০০ টাকা— সব ক্ষেত্রেই একই চিত্র , অস্বাভাবিক কম উৎপাদনমূল্য + বিশাল লাভ = নিম্নমানের উৎপাদনের সন্দেহ। এমনকি অভিযোগ আছে—এলবিয়নের ‘এসপ্রিন’ মাথাব্যথার ওষুধ পানিতে দ্রবীভূতই হয় না।
মানহীন ও নকল ওষুধের জন্য এলবিয়ন ফ্যাক্টরি সিলগালা হয়েছিল : এর আগেও চট্টগ্রামের চাঁদগাঁও কারখানা ভ্রাম্যমাণ আদালত সিল করে দেয়। পরে DGDA-এর অনুমতি নিয়ে সীতাকুণ্ডে নতুন কারখানা স্থাপন করা হয়।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়— যে প্রতিষ্ঠানকে মানবহির্ভূত ওষুধ উৎপাদনের জন্য সিল দেওয়া হয়েছিল, তারা কীভাবে নতুন করে অনুমতি পেল ? DGDA কি যথাযথ যাচাই-বাছাই করেছিল?
শত শত কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি—দুদকে বিস্ফোরক অভিযোগ : ২০২৩ সালের ৫ জানুয়ারি দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগে বলা হয়—-মাত্র পাঁচ বছরে আমদানির তথ্য গোপন: ১১৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। বিক্রয়ের তথ্য গোপন: ৪৯২ কোটি ২০ লাখ টাকা : প্রতিবছরের হিসাব (সারাংশ): করবর্ষ আমদানি গোপন বিক্রি গোপন, ২০১৭–১৮ ১৩.৯৫ কোটি ৮৩.১৯ কোটি, ২০১৮–১৯ ১৪.৯৭ কোটি ৮৯.২১ কোটি, ২০১৯–২০ ২৫.৭৮ কোটি ৯৯.০৬ কোটি, ২০২০–২১ ৪৯.২৬ কোটি , ১২৯.৭৫ কোটি, ২০২১–২২ ১৪.২৮ কোটি এবং ৯১.৯৭ কোটি টাকা। এছাড়া—বেনামে ৭ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ, ১১টি দামি গাড়ি বেনামে, ৯+ ব্যাংক হিসাব গোপন, এসব তথ্যও অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন—–“এসব কম্পোজ করা বানোয়াট তথ্য। আমাদের সুনাম নষ্ট করতে এসব রটানো হচ্ছে।”
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে নিয়ে জনমনে তীব্র প্রশ্ন : এতসব অভিযোগ—মামলা, মানবহির্ভূত ওষুধ, GMP লঙ্ঘন, কারখানা সিলগালা, রাজস্ব ফাঁকি—সব ঘটনার মাঝখানে বড় প্রশ্ন এখন একটাই, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এতদিন কী করছিল ? বাজারে পরীক্ষায় মানবহির্ভূত অ্যান্টিবায়োটিক, পশুর ওষুধ ও মানুষের ওষুধ একই ভবনে উৎপাদন, GMP লঙ্ঘন, কম দামে সন্দেহজনক উৎপাদন, আগেও সিলগালা ছিল কারখানা, এসবের পরও এলবিয়ন কীভাবে নিয়মিত উৎপাদন ও বিপণন চালিয়ে গেল?
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন— “DGDA আরও আগেই ব্যবস্থা নিলে বাজারে নিম্নমানের ওষুধের প্লাবন হতো না।”
উপসংহার : এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজের বিরুদ্ধে একের পর এক ভয়ংকর অভিযোগ এখন শুধু প্রতিষ্ঠান নয়—ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা ও মাঠপর্যায়ের নজরদারির ওপরও বড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে।
দেশের মানুষের জীবনরক্ষাকারী ওষুধের মান নিশ্চিত করা যেখানে রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব—সেখানে মানবহির্ভূত অ্যান্টিবায়োটিক বাজারে ঘুরে বেড়ানো নিঃসন্দেহে এক ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি।
এখন দেখার পালা— DGDA, দুদক, ও সংশ্লিষ্ট আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কতটা কঠোর তদন্তে নামবে।
