নিজস্ব প্রতিবেদক : গণপূর্ত অধিদপ্তর মানেই যেন দুর্নীতি, কমিশন আর সিন্ডিকেটের অভয়ারণ্য। আর এই চক্রের “বরপুত্র” হলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. কায়কোবাদ। চুয়েটের ছাত্রলীগ ঘরানার এই সাবেক ফ্যাসিস্ট দোসর আজ সরকারি পদে বসেও অবৈধ টাকা বানানোর নতুন নতুন মিশন বাস্তবায়ন করছেন। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো—এই দুর্নীতি ঢাকতে তার হাতিয়ার সাংবাদিকদের কলম নয়, তাদের পকেট!

সাংবাদিক নাকি ঠিকাদার? নাকি দুটোই ? : কায়কোবাদের চারপাশে যে দলটি ঘুরপাক খাচ্ছে, তারা কেউ সাংবাদিক, কেউ ঠিকাদার—আবার কেউ একসাথে দুই ভূমিকায়! কেউ শ্যালক, কেউ ছোটভাই, কেউ আবার মনরঞ্জনের সরবরাহকারী। এরা নিজেদের নাম সর্বস্ব পত্রিকার মালিক বা সম্পাদক সাজিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। “সাপ্তাহিক বগলদাবা”, “অর্ধবার্ষিক দৈনিক”, কিংবা “হঠাৎ অনলাইন নিউজ” নামের মিডিয়া দিয়ে কায়কোবাদের দুর্নীতিকে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের সততার গল্পে রূপ দিচ্ছে।
এরা মাঝে মাঝে সংবাদপত্রে কায়কোবাদের পক্ষে বিজ্ঞাপন ছাপে—কখনো আবার দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হলে সেটিকে “তথ্য সন্ত্রাস” বলে চালায়। এক কথায়, চোরের মুখে রামনাম আর গলাতে মিডিয়ার মেকআপ!


মোহন চক্রের কারসাজি : এই দালাল দলের অন্যতম চরিত্র হলো কথিত সাংবাদিক মোহন। গত ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর তিনি “হত্যাকারী বানানোর ভয়” দেখিয়ে গণপূর্তের কয়েকজন কর্মকর্তার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। আবার যারা টাকা দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজানোর অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে। ঠিকাদারি ব্যবসা আর মিডিয়াকে একসাথে চালানোতে তিনি যেন “দুই হাতে লুট” তত্ত্বের সেরা উদাহরণ।

আলী আকবর-ঠিকাদার লিগ : কায়কোবাদের আরেক বিশ্বস্ত সঙ্গী মিলেনিয়াম ট্রেডার্সের মালিক আলী আকবর। এই ঠিকাদার কাম দালাল কায়কোবাদের প্রতিটি দুর্নীতির প্রজেক্টে লেজুড়বৃত্তি করে। কমিশন ভাগাভাগি থেকে শুরু করে টেন্ডার সিন্ডিকেট—সব জায়গাতেই তিনি কায়কোবাদের পার্টনার ইন ক্রাইম।

তত্তাবধায়ক প্রকৌশলী মো : কায়কোবাদের প্রশ্রয়দাতা অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারের বিরুদ্ধে ও বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ :
ভিআইপি প্রোগ্রামের নামে অর্থ লোপাট : অভিযোগ রয়েছে যে, ভিআইপি প্রোগ্রামের নামে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
টেন্ডারে অনিয়ম : বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি নিজের পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতে টেন্ডার ম্যানিপুলেশন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে রমনা পার্কের চাইনিজ রেস্টুরেন্টের টেন্ডার নিয়ে তার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।
অবৈধ সম্পদ অর্জন : তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। দুদক তার সম্পদের বিষয়েও অনুসন্ধান করছে।
হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (HBRI) মহাপরিচালক থাকাকালীন দুর্নীতি : এইচবিআরআই-এর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে জেনারেটর, সাবস্টেশন ও অটো ব্লক মেকিং প্ল্যান্ট স্থাপনসহ বিভিন্ন কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম : অভিযোগ রয়েছে যে, নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি অতিরিক্ত কর্মীর বেতন উত্তোলন করেছেন, যা তিনি আত্মসাৎ করেছেন।
পদোন্নতি ও বদলি বাণিজ্য : গণপূর্ত অধিদপ্তরের বদলি ও পদোন্নতিতে তিনি একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন এবং এর মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অন্যান্য প্রশাসনিক অনিয়ম : তার বিরুদ্ধে দাপ্তরিক কার্যক্রমে ক্ষমতা অপব্যবহার, অনিয়ম, এবং স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও রয়েছে।
কমিশনের হাড়ভাঙা অঙ্ক : গণপূর্ত ভবনে এখন খোলাখুলি “কমিশন টেবিল” চলে। কাজ নিতে চাইলে প্রথমে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীকে ৫%, পরে নির্বাহী প্রকৌশলীকে ১০%, আর শেষে কায়কোবাদের অফিসে ৫% দিতে হয়। মোট যোগ করলে দাঁড়ায় ২৫-২৮% কমিশন! কাজের মান কেমন হলো—তা গৌণ ব্যাপার। টাকা দিতে পারলেই কাজ মিলবে, না হলে তালিকায় নাম ওঠা স্বপ্নই থেকে যাবে।
বিলাসী কায়কোবাদ : একজন সরকারি কর্মকর্তার বেতনে যেখানে সংসার চালানোই কঠিন, সেখানে কায়কোবাদের সম্পদের বহর যেন সিনেমার গল্প। মোহাম্মদপুরে কোটি টাকার ফ্ল্যাট, ধামরাইতে ১০ তলা ভবন, গ্রামের বাড়িতে জমি-জমা, লেটেস্ট মডেলের প্রিমিও গাড়ি—সবই কেবল “ভুয়া প্রাক্কলনের” জাদুতে।
সাংবাদিক পরিচয়ে সন্ত্রাস : সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, এই দালাল সাংবাদিক সিন্ডিকেট কেবল দুর্নীতি আড়ালই করছে না—বরং সত্যিকার সাংবাদিকদেরও হুমকি দিচ্ছে। যারা কায়কোবাদের কালো কারসাজি ফাঁস করছে, তাদের রক্ত ঝরানোর হুমকি চলছে। ফলে গণপূর্ত ভবনের ভেতরে এখন সাংবাদিকতার নামে চলছে তথ্য সন্ত্রাস আর প্রিপেইড নিউজের বাণিজ্য।
শেষ কথা : কায়কোবাদ-শামীম আখতার জুটি, আলী আকবর-মোহন চক্র আর তাদের পোষা সাংবাদিকদের নিয়ে গড়ে উঠেছে গণপূর্তের সবচেয়ে ভয়ংকর সিন্ডিকেট। এখানে টেন্ডার মানে টাকা, সাংবাদিকতা মানে দালালি, আর পদোন্নতি মানে ১০ কোটি টাকার প্যাকেজ।
এই সিন্ডিকেটের কার্যক্রম দেখে সচেতন মহল বলছে—“গণপূর্ত ভবন এখন ঠিকাদার, প্রকৌশলী আর দালাল সাংবাদিকদের দুর্নীতির চিড়িয়াখানা। এখানে সবাই দুর্নীতির পশু, শুধু নামের তফাৎ!”