গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রভাবশালী প্রকৌশলীদের অনিয়মের রিপোর্ট ঠেকাতে ‘গৃহপালিত সাংবাদিকতার’ মহড়া — সংবাদ স্বাধীনতার নতুন লজ্জা  ?

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক  : গণপূর্ত অধিদপ্তরের কিছু প্রভাবশালী প্রকৌশলীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে সদা প্রস্তুত একটি ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী সাংবাদিকচক্র সম্প্রতি এমন এক নজির স্থাপন করেছে, যা সংবাদপত্র আইনের মৌলিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের মানহানি স্বরূপ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।


বিজ্ঞাপন

দুর্নীতি, অনিয়ম বা ‌দুর্ব্যবস্থাপনা নিয়ে যেকোনো পত্রিকার অনুসন্ধানী সংবাদ হলো গণতান্ত্রিক সমাজের শুদ্ধির প্রক্রিয়া। কিন্তু এই দেশে দেখা যাচ্ছে চিত্র ঠিক উল্টো—বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত অনিয়মের সংবাদ খণ্ডন করতে আরেকদল সাংবাদিক নেমে পড়েছেন ‘দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রক্ষায়’ গৃহপালিত প্রচারযুদ্ধে।

যেখানে সাংবাদিকতার মূল কাজ সত্য অনুসন্ধান, সেখানে ‘নেতিবাচক রিপোর্টের প্রতিবেদন প্রতিরোধ’ এখন কিছু সংবাদমাধ্যমের নতুন ব্যবসা—এমন মন্তব্য করেছেন গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।


বিজ্ঞাপন

যে রিপোর্টের জবাবে ‘জবাব রিপোর্ট’: সংবাদপত্র আইনের কোন ধারায় ?   সম্প্রতি ই/এম শাখার প্রকৌশলী মো. কায়কোবাদকে নিয়ে কয়েকটি অনলাইনে ইতিবাচক ও সাফাইকেন্দ্রিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টগুলোতে দেখা গেছে— একটি পত্রিকার অনুসন্ধান প্রতিবেদনকে উল্লেখ করে অন্য পত্রিকা বা পোর্টাল এমনভাবে সাফাই গাইছে, যেন সংবাদপত্র নয়, কোনো ব্যক্তির পক্ষসমর্থনই তাদের মূল দায়িত্ব।


বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি স্পষ্টতই— সংবাদপত্র আইন ১৯৭৩-এর স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী, পেশাগত নীতিমালা ভঙ্গ, সাংবাদিকতার ‘স্বার্থসংঘাত অবৈধ চর্চা’, অযথা ব্যক্তি প্রচার—যা সাংবাদিকতা নয়, বরং বিজ্ঞাপনধর্মী ‘পিআর প্রচার’

আইনজীবীরা বলছেন, “যে রিপোর্টে অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ আছে, তার খণ্ডন করতে হলে তথ্য-প্রমাণসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষ আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেবে—এটাই নিয়ম।

কিন্তু এক পত্রিকার রিপোর্টকে ঢাকার জন্য আরেক পত্রিকায় সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষে ব্যক্তিগত সাফাই—এটা আইনসম্মত নয়, বরং প্রেস এথিকস লঙ্ঘন।”

ছবি ভ্রান্তি, তথ্য বিভ্রাট—‘সাফাই সাংবাদিকতায়’ নতুন ট্র্যাজেডি : যে পত্রিকাগুলো সাধারণত দুর্নীতি বা অনিয়ম উন্মোচন করে, সেগুলোকে টার্গেট করে প্রকাশিত পাল্টা-রিপোর্টগুলোতে দেখা গেছে– ভুল ছবি ব্যবহার, ভুল পরিচয়, তথ্যগত অসঙ্গতি, ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কহীন তথ্য জোড়া, পিআর স্টাইলে ব্যক্তির প্রশংসা,

যা পেশাদার সাংবাদিকতার মূল নীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

এক সম্পাদক ব্যঙ্গ করে বলেন,  “এ ধরনের ভুল শুধু অদক্ষতার পরিচয় নয়, বরং জনসচেতন সংবাদকে নিষ্ক্রিয় করার কৌশল।”

অনিয়মের সংবাদ দূর করতে নতুন কৌশল—‘প্রকৌশলীদের দালাল ব্রিগেড ’?  গণপূর্তের ভেতরের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান—গনপূর্ত অধিদপ্তরের প্রভাবশালী কিছু প্রকৌশলী দীর্ঘদিন ধরে কয়েকজন সাংবাদিককে ব্যবহার করে নিজেদের চিত্র পালিশ করে আসছেন।

যখনই কোনো অনিয়ম প্রকাশিত হয়, তখনই— অভিযুক্ত কর্মকর্তার ছবি এড়িয়ে অন্য কারো ছবি ব্যবহার, অনলাইন পোর্টালে ‘হঠাৎ’ প্রশংসামূলক প্রতিবেদন বন্যা, সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের কাছে ফোন করে ‘নরম করার কূটনীতি’ । আরেক পত্রিকায় ওই প্রতিবেদনকে ভুল প্রমাণের নাটক,—এসব হচ্ছে নিত্য চিত্র।

এক কর্মকর্তা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, “দুর্নীতির রিপোর্ট দেখলেই ওরা দালাল সাংবাদিক পাঠায়! গণমাধ্যম নষ্ট করছে, সরকারকেও বিব্রত করছে।”

যেখানে দুর্নীতি আছে—সেখানে সাফাই? না কি সত্য আড়াল ?  অনিয়ম, দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে যে কোনো সাংবাদিকতার প্রথম শর্ত— তথ্য প্রকাশ, প্রশ্ন তোলা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

কিন্তু এখানে উল্টো— একটি পত্রিকা প্রশ্ন তুললেই আরেকটি পত্রিকা জবাব দেয় ‘মহান প্রকৌশলী’ কতটা সৎ, কতটা দক্ষ এবং কীভাবে তাঁর নিন্দা করা অমানবিক(!)।

এটি কোনোভাবেই সাংবাদিকতা নয়— এটি কৌশলী মুখ বন্ধ করা,
এটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিবন্ধকতা তৈরি, এটি গৃহপালিত সাংবাদিকতার স্পষ্ট নমুনা।

যা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ :  দেশের সিনিয়র সাংবাদিক ও গণযোগাযোগবিদদের মধ্যে এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁদের মতে—সাংবাদিকের কাজ সত্য উদঘাটন, ব্যক্তির প্রচারণা নয়।

দুর্নীতি তদন্তকারী পত্রিকার বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর।  স্বার্থান্বেষী প্রকৌশলী-সাংবাদিক মিলনমেলা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে আরও অস্বচ্ছ করে তুলছে। এ ধরনের প্রচার দুর্নীতিবাজদের সাহস বাড়ায়, প্রকৃত সাংবাদিককে নিরুৎসাহ করে।

এক বিশ্লেষক বলেন, “এই সংস্কৃতি চলতে দিলে আগামী দিনে দুর্নীতি নয়, দুর্নীতি রক্ষাকারী সাংবাদিকতাই সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।”

স্বচ্ছতা রক্ষায় প্রয়োজন তথ্যভিত্তিক সাংবাদিকতা, সাফাই নয় : গণপূর্তের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। যেখানে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, সেখানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিহার্য।

কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে—যে পত্রিকা অনিয়মের খবর করে, সে ‘বিপদে পড়ে’; আর যে পত্রিকা অনিয়ম আড়াল করে, সে পুরস্কৃত হয়। এটি রাষ্ট্র, করদাতা এবং গণমাধ্যম—তিন পক্ষেরই জন্য বিপজ্জনক।

উপসংহার : অনিয়ম আড়াল করতে সংবাদ ব্যবহার—গণমাধ্যমের অপমান,  গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যম কখনোই কারো ব্যক্তিগত ‘ঢাল–তলোয়ার’ নয়, কারো ‘পিআর শাখা’ও নয়। কিন্তু গণপূর্তে বর্তমান প্রেক্ষাপট দেখে মনে হয়—অনিয়ম প্রকাশের চেয়ে অনিয়ম লুকানোর সাংবাদিকতাই কিছু মানুষের প্রিয়।

এটা শুধু অনৈতিক নয়— এটা রাষ্ট্রের শুদ্ধিকরণের উপর সরাসরি আঘাত । এক পত্রিকার রিপোর্ট ঠেকাতে আরেক পত্রিকার সাফাই—সংবাদপত্র আইন লঙ্ঘনের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। সত্যকে চাপা দেওয়ার এই অপচেষ্টা বন্ধ করা জরুরি—আসল প্রমাণ, সত্য অনুসন্ধান ও নিরপেক্ষ তদন্তই যে কোনো কর্মকর্তার প্রকৃত মুক্তি এনে দিতে পারে  ;গৃহপালিত সাংবাদিকতা নয়।

👁️ 113 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *