ইন্টারভিউ

সাহিত্য

কাজী আরিফ : বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আমি তখন মাত্র খোলা মাঠটাতে পা দিয়েছি । একটা হাওয়া দুদ্দাড় করে ছুটে এসে আমায় গিলে খেতে চাইল ।
নদীটা আরেকটু দূরে ।


বিজ্ঞাপন

দূর থেকেই নদীর পাড়ে সবুজ শটি বনের সারি দেখলাম, কিছু ফার্ন জাতীয় এবং ছোট ছোট কানসিরা, আকন্দ গাছও দেখা গেল ।কিছু শীর্ন বাঁশ গাছ ছানাপুনা নিয়ে হাওয়ায় ঝুকছে বাতাসের দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে ।হটাৎ দেখলে মনে হবে হাওয়ার সাথে বাঁশ এবং অন্যান্য বড় গাছগুলি কোন একটা খেলা করছে ।বাতাস ডানে গেলে ওরা ডানে কাত হচ্ছে বায়ে গেলে বায়ে । ঠিক অমন একটা সময়ে আমি প্রায় নদীর পাড়ে পৌছাব ঠিক তখনই দ্রুতগামী দুটো মেঘের সংঘর্ষে বিদ্যুৎ চমকালো । মনে হল কাছে পিঠে কোথাও বাজ পড়ল ।একটা গরু হাম্বা হাম্বা করতে করতে গলায় দড়িসমেত আমার খুব কাছ দিয়ে দৌড়ে গেল। শ্রবণ দূরত্বে বাচ্চার কান্না, ছাগলের আর্ত চিৎকার শুনে মনে হল নদীর পাড়ের এই জনপদ আমার থেকে খুব বেশী দূরে না ।

আমি ইচ্ছে করলে ফের নদীপাড়ের ঐ বাড়িটাতে আবার যেতে পারি ।
আবার নাও পারি । আমার ইচ্ছে । আমি যে বাড়িটার কথা বললাম , আমি ঐ বাড়িটাতে আমি আরেকবার যেতে চাইব কিনা বা পারি কিনা সেটা নিয়ে ব্যাপক সংশয় আছে ।কেননা ঐ বাড়িটার প্রবেশ পথের ছাইগাদার পাশে যে কচুগাছ আর তার পাশেই দাঁড়ানো যে লিচুগাছটা আছে এর মাঝখানের ছোট্ট জায়গাটায় একটা সমস্যা আছে ।আমি সেই সমস্যাটা নিয়েই এসেছিলাম ।

ওই বাড়িটা বা এই নদীরপাড়ের বেশীরভাগ মানুষই বাংলাদেশের প্রান্তিক আদিবাসী ।যাদেরকে আমরা অবশ্য বলি, আমাদের আদিপুরুষ,- অষ্ট্রিক জাতি ।মূলত এখন ওদের মধ্যে অষ্ট্রিক ও মংগোলয়েড ছাপ দুটোই আছে ।গায়ের রং মিক্সড ।কিন্ত কোনভাবেই ওদের শারীরিক অবয়ব গড়পড়তার বাংলাদেশী বাঙ্গালীদের মত না ।অবশ্য বাংলাদেশী বাঙ্গালী মারাত্মক রকমের শংকর একটা জাতি । এ জাতির মধ্যে সব ধরনের শারীরিক অবয়ব বিদ্যমান ।এই নদীরপাড়ের জীবনের মধ্যে বেশীরভাগই একটু আদিবাসী গোছের ।কিন্ত গায়ের রংটা বেশ মাজা ।

যে বাড়িটার কথা বলছিলাম সেই বাড়িটার একটা মেয়ে যে কিনা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেত, সাথে নিয়ে যেত এক আকাশ উথাল্ পাথাল সবুজ হাওয়া আএ একরাশ স্বপ্ন ।।পড়াশুনায় ভালোও ছিল ।তার মা বাবা স্বপ্ন দেখেছিল মেয়েটা একদিন সত্যিই ভাল কিছু করবে ।

স্কুল সমাপনী সে ভাল ভাবে শেষ করে হাইস্কুলে যেত সাইকেল চালিয়ে ।

নদীর পাড়ের সরু পায়ে চলা পথে সে বেল বাজিয়ে দারুন নিপূনভাবেই যে যেতে পারত ।বেনী করা চুল পিঠের উপর সচল সাপের মত দুলতো, গ্রীবা, কোমর সোজা ও উচু করেই সে সাইকেল নিয়ে স্কুলে যেত ।পুরনো সাইকেলটা তার ছোয়ায় যেন পঙ্খিরাজের মত তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেত ।সবাই অবাক হয়ে তার যাওয়া আসা দেখত । নদীর পাড়ে কাজ করতে থাকা মানুষগুলো কাজ থামিয়ে তার এই আসা যাওয়া দেখত যেন এর চে ভাল কোন দৃশ্য তারা অনেক বছরে দেখেনি ।এই যে কুলিকামিনের ঘরের মেয়ে সে তো বোঝাই যায়না । কী নিপূনতা, কি সুন্দর। একটা ব্যাগ রাখা থাকত ফ্রন্ট ক্যারিয়ারে।সেটা বইয়ের ব্যাগ।

অনেকে বলে , ‘আমাগের মেইয়াগো এমন ডাট আসিলি কোথা হতে ?কার মেইয়া রে বাপু’

কেউ উত্তর দেয়, ‘আরে উই মেইয়া লিখাপড়ায় খুব ভাল আছে,ফাসট হয় ।ফাসট হয়ে টাকাপয়সা পায়’

কুলিকামীনদের চোখে স্বপ্ন খেলা করে ।
‘এই মেইয়া একদিন বড় কিছু কইরবে ? স্বাস্থ্য আপা হইবেক নাইলে স্কুলে মাস্টরি কইরবে’

মেয়েটা প্রজাপতির মত উড়ে বেড়ায়। নদীর পাড়ে বড় শিমুল গাছটার নিচে বসে । বিকেলের সোনারোদে তার উজ্জ্বল মুখে আনন্দ খেলা করে। পিতার দারিদ্রতা থাকলেও তাকে এসব ছোঁয় না । সে সাইকেলখানা পেয়েছে এনজিওর থেকে। আজকাল এসব এনজিওরা অনেক কিছু করে। মেয়েদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে শিক্ষা দেয়, স্যানিটারি প্যাড দেয়, হাত ধোয়া শেখায়।

এসব দেখে পাড়ার মুরুব্বী মহিলারা হাসে।
‘আমাগি সময়ে ইসব ত কিছু জানতাম না, আমরা কি বড়নোক হয়ে গেলাম নাকি’

কিন্ত প্রজাপতির মত উড়ে বেড়ানো , সাইকেল চড়া মেয়েটির দিকে পাড়ার সবাই সুনজর দিলেও এলাকার মেম্বারের ছেলেটা সুনজর দিতে পারেনা । তার চোখে না তার তার মাথায় যত কুচিন্তা।

‘কুলি কামিনদের এত লেহাপড়ার দরকার কি? এইসব এইনজিও এসে সবার মাথা খাইছে। এগো লেহাপড়ার জন্যি বাড়িতে কাজের লোক পাওয়া যায়না’

মেম্বারের ছেলে সারাগ্রামে দলবল নিয়ে ঘোরে। উঠতি মেয়ে আর বৌদের জ্বালায়। আদি রসাত্মক কৌতুক করতে চায়। কুঈঙ্গিত করে। একদিন মেয়েটার সাইকেল আটকায় ফাঁকা রাস্তায়-

‘আরে তুই মালা না ? সেদিনের ছোট্ট মাইয়াডা কত বড় হয়ে গিছিস। তা কোন ক্লাসে পড়িস রে’

এই বলে আর মেম্বারের ছেলের চোখ সারা শরীর ঘুরে বেড়ায় ।ওড়না ঢাকা থাকাতে তাকে দেখে মেম্বারের ছেলে খুশী হতে পারেনা। তার চোখ হয়ত অন্য কিছু খুঁজে বেড়ায়।

মালা খুব ভাল করে চেনে মেম্বারের ছেলেকে।
ভয় পায়, মনে ঘৃণা ও জন্মে। কিন্ত প্রতিবাদ করতে গেলে শক্তি লাগে সে সেটা বুঝতে পারে। কিছুকাল আগেও তার মা মেম্বারের বাড়িতে কাজ করেছে তা মালার মনে আছে। বলে,
‘ভাই, মার দেরী হয়ে যাচ্ছে, যাইতে দেন’

‘যা । তবে তোর কাছে আসবোনে একদিন রে, মালা’

মালা ভয়ে কুঞ্চিত হয়ে আসে। চোখ ফেটে জল আসে । আসতে আসতে রাস্তার গাছগুলোকে, সবুজ পাতাগুলোকে , রাস্তার ধূলোকে বলে ‘আমারে বাঁচাও।আমারে পইড়তে দাও।আমি মেট্রিক পাশ কইরতে দাও’

কিন্ত একদিন মেম্বারের ছেলে ও তার বন্ধুরা রাতের আঁধারে ওঁত পেতে থাকে মালাদের বাড়ির পেছনের জংগলে।
প্রাকৃতিক ডাকে বাইরে আসলেই মুখ চেপে তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং ধর্ষনের পর গলা চেপে হত্যা করে ফুলের মত মেয়েটাকে।

আমি সেই ঘটনার ডিটেইলস রিপোর্ট লেখবার জন্য মালাদের বাড়ি এসেছিলাম মা বাবা আর পাড়াপড়শীর ইন্টারভিউ নেবার জন্য। ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেছে – – –

ও হ্যা , ওই লিচুগাছ আর কচু গাছের মাঝখানের জায়গাটায় মালাকে সমাহিত করা হয়েছে। ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে বারবার আমার চোখের সামনে ত্রয়োদর্শী বা চতুর্দশী মেয়ের সগর্বে নিপূনতার সাথে সাইকেল চালানোর অপূর্ব একটা দৃশ্য মাথায় ঘুরছে। কিছুতেই নামাতে পারছি না । কিছুতেই না।