বিষন্ন অনুপ্রাস

অন্যান্য বিবিধ

হোসেন আবদুল মান্নান : ছোট্ট একটি অনুবন্ধ দিয়ে পাট নিয়ে কিছু বলা যেতে পারে। বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষের বিশেষ অঞ্চল হিসেবে আমাদের নিম্নগাঙেয় ব-দ্বীপে উৎপাদিত যে ক’টা পন্য দুনিয়াব্যাপী প্রসিদ্ধি পেয়েছিল তার মধ্যে পাটই সম্ভবত প্রথম এবং প্রধান বলে বিবেচিত। পূর্ব বাংলায় পাট উৎপাদনের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে এবং অব্যবহিত পরেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সোনালী আঁশের ন্যায্য মূল্য নিয়ে বাংলার কৃষকের পক্ষে বার বার অবস্থান নিয়েছেন। একাধিক বক্তৃতায় তিনি আফসোস করে বলেছিলেন, আমরা পাটকে যথার্থভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। সময় পেলে তিনি অবশ্যই কিছু করতেন।


বিজ্ঞাপন

স্মরণাতীত কাল থেকে এদেশে ‘মসলিন’র যেমন খ্যাতি, কিংবদন্তি এবং বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল পাটের বেলাও তদ্রুপ। ভারতবর্ষের বাইরে তখনই পাটজাত দ্রব্য বা পন্যসামগ্রির ব্যাপক উৎপাদন, রূপান্তর ও বাজারজাতকরণ চালু ছিল। কাঁচামাল হিসেবে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর কাছে পাটের চাহিদা ছিল অননুমেয়। পাটের প্রতিশব্দ সোনালি আঁশ (golden fibre) নামকরণ আসলে তাদের নিমিত্ত এবং তাদেরই করা।

২) কেবল জনশ্রুতি নয়, ঐতিহাসিক বাস্তবতাও সাক্ষ্য দেয়, ভারতবর্ষের যে সকল স্হানে প্রথম রেললাইন স্হাপন করা হয় সে এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি পাট উৎপাদন হতো। বৃটিশরাজ রেললাইন সংযোজনের মত এমন ব্যয়বহুল কাজে হাত দেয় মূলত: পাট পন্যবাহী যানবাহন হিসেবে, মানুষের দৈনন্দিন যাতায়াতের জন্য নয়। দু’একটি দৃষ্টান্ত টেনে বলা যায়- বৃটিশরা ১৮২৫ সালে তাদের নিজেদের দেশে অর্থাৎ ইংল্যান্ডে রেল চালু করে। ভারতে তারা প্রথম চালু করে ১৮৫৪ সালে। কলকাতার হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত মাত্র ৩৮ কি:মি: লাইন। পূর্ব বাংলায় প্রথম রেল চালু হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কুষ্টিয়ার জগতী থেকে দর্শনা পর্যন্ত। (ঠিক একশত বছর পরে একই দিনে আমার জন্মদিন বিধায় তারিখটি ভুল হয় না)। এসব তথ্য নির্ভরযোগ্য যে, তখন কুষ্টিয়া অঞ্চলে অনেক বেশি পাট চাষ হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৈতৃক ব্যবসা বা দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পাট ব্যবসার কথা সবাই জানি।
রেললাইন শুরুতে গণপরিবহন হিসেবে যাত্রা শুরু করেনি তার আরও একটি প্রমান হলো –ময়মনসিংহ থেকে কেবল কাঁচা পাট কলকাতায় নেয়ার জন্য তারা ১৮৮৫ সালে ময়মনসিংহ – ঢাকা – নারায়ণগঞ্জ রেললাইন চালু করে। এক্ষেত্রে তারা তখন পর্যন্ত ঢাকাকে নারায়ণগঞ্জের চেয়ে কম গুরুত্ব দিয়েছিল। এটি সর্বজনজ্ঞাত যে, বৃহত্তর ময়মনসিংহের মাটি পাটের জন্য সর্বাধিক উপযোগী ছিল।

৩) আমার প্রপিতামহ কোন ছোট-খাটো ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন কিনা জানা নেই । তবে তিনি যে বংশানুক্রমভাবে কৃষক ছিলেন তা ধ্রুবসত্য। পিতামহ এবং পিতা উভয়ই গ্রামীন পর্যায়ের পাট ব্যবসার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন তা আমি নিজেই প্রত্যক্ষদর্শী। আমাদের নিজের জমিতে পাট উৎপাদন করা এবং মৌসুমে স্হানীয় বাজার থেকে প্রচুর পরিমানে পাট কেনার সাথে আমার চাচারাও বাবার সহযোগী ছিলেন। সেই স্কুলপড়ুয়া আমিও বাজারে পাট ক্রয়ের কৌশল, হিসাব-নিকাশ, পাটের ক্রয়কৃত বস্তা দেখভাল করা, বড় বড় ঘরে ক’দিনের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা, কোমরে বাঁধা খতি থেকে খুচরা বিক্রেতাকে টাকা গুনে দেওয়া,নৌকায় করে পাট নিয়ে আসা, হিসাবের খাতায় লিখে রাখা ইত্যাদি দায়িত্বের কথা আজো স্পষ্ট মনে পড়ে। মনে পড়ে, ঘরভর্তি পাটের ওপরে শুয়ে থাকা, পাটের ভেতর লুকোচুরি খেলা, রোদ-বৃষ্টির আসা যাওয়ার ফাঁকে পাট ধুয়া, পাট শুকানোর লাগসই প্রযুক্তির কথা। বর্ষার জলে ডোবা-নালা খাল-বিল থৈথৈ, তবুও কাদা মাটির গহীন ভেতর থেকে পঁচা পাটের সুধাগন্ধ আজো যেন আমার পঞ্চইন্দ্রিয়কে অপরূপ মগ্নতা দিয়ে চলে। ভাটি বাংলায় আমাদের আদি নিবাস হেতু বর্ষা এলে বাড়ির ঘাটেই ভিড়ে থাকতো ঘরের মত বড় পাটের নৌকা। বাবা চাচারা এসব নৌকায় পাট ভরে দিতেন। ক’দিন অন্তর অন্তর নৌকাগুলো এসে আমার বাবার কাছ থেকে পাট নিয়ে তারা আরও ভাটিতে আঞ্চলিক গুদামে ফিরে যেতো। পারিবারিক ভাবে আমাদের পাট ব্যবসার সে-ই সরঞ্জামাদি যথা– কামান, এক মণ বা আধা মণি পাথর, কাঠের পাল্লা ইত্যাদি এখনো বাড়িতে রয়ে গেছে।

৪) কী আশ্চর্য! অনেকটা কাকতালীয় ভাবেই চাকরির একেবারে শেষ দিকে এসে আমি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে গেলাম।এতে বরং নিজেকে গর্বিত বলেই বিবেচনা করছি। ভাবছি, আমি কি আবার আমার মূল বা শেকড়কে স্পর্শ করতে যাচ্ছি ? মনে হয়, কে যেন আড়াল থেকে আমাদের অতীত দিনের অস্তিত্ব, শৈশব-কৈশোরের দ্যুতিময় সময় ও স্মৃতিকে পুনঃ আলিঙ্গন করার এক অদৃশ্য সেতু রচনা করে দিচ্ছে। তাহলে এ কি আমার হারিয়ে যাওয়া কৈশোরের বর্ণিল সেই দিনলিপির পুনর্পাঠ নাকি অন্য কিছু?