রাজধানীতে বাড়বে ডেঙ্গুর প্রকোপ

অন্যান্য এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন ঢাকা রাজধানী স্বাস্থ্য

#ডেঙ্গু জ্বর হলে যা করবেন #ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকার কী করছে?
মহসীন আহমেদ স্বপন : বর্ষা মৌসুম শুরু হতে না হতেই আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেঙ্গু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গেলো মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত রাজধানীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৮১ জন। আর মৃতের সংখ্যা ৪, যা একই সময়ে গত দুই বছরের তুলনায় বেশি। তাই এখনই ডেঙ্গু প্রতিরোধের পাশাপাশি তা মোকাবিলায় সমন্বিত পরিকল্পনার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। কর্তৃপক্ষ বলছেন, প্রস্তুতিতে ঘাটতি নেই তাদের।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের আট তারিখ পর্যন্ত ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ২৯৫। এটি কেবল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এমন রোগীর সংখ্যা। এর মধ্যে এপ্রিলে দুজন রোগী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন। কিন্তু গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৩৩জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ বিভাগের পরিচালক সানায়া তাহমিনা বলেছেন, জরিপে তারা দেখেছেন ঢাকায় বাসাবাড়িতে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার জীবাণুবাহী এডিস মশা জন্মের হার বাড়ছে এবং এর ফলে এবছর ডেঙ্গুর প্রকোপ আগের চেয়ে বেশি হওয়ার আশংকা রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা বছরে তিনবার এই জরিপ করি। একটা প্রি-মনসুন মানে বর্ষা শুরু হবার আগে, একটি বর্ষা মৌসুমে এবং আরেকটি বর্ষার পরে। মার্চে যে প্রি-মনসুন জরিপ চালিয়েছি তাতে দেখা গেছে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের সূচক ঢাকায় এখন ২২ শতাংশ। তিনি বলেন, এই সূচকের মানে হলো, এডিস মশার প্রতি একশটি প্রজনন উৎসের মধ্যে কতটিতে এডিস মশার লার্ভা রয়েছে। এখন যদি ২০টিতে মশার লার্ভা পাওয়া যায় তাহলে সেটাকে বিপজ্জনক বলে ধরা হয়। জরিপে সেটা ২২ শতাংশ, মানে এটা এখন বিপজ্জনক সীমারও বেশি। আর যেহেতু এই জরিপ বর্ষা শুরুর আগে, ফলে বর্ষা শুরু হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার খুবই আশংকা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জরিপটি চালিয়েছে ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশনের ৯৭টি ওয়ার্ডের ১০০টি জায়গায়। এসব এলাকার প্রায় এক হাজার বাড়ি ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মীরা। এর মধ্যে নির্মাণাধীন বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং এবং পুরনো ভবনসমূহে এ জরিপ চালানো হয়েছে।
সানায়া তাহমিনা জানিয়েছেন, জুন মাসের প্রথম আটদিনেই ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৪৬জন রোগী। তিনি মনে করেন, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর বাইরেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আরো অনেক মানুষ রয়েছেন, যারা অনেক সময় চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হন না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপের ফলাফল ইতিমধ্যেই সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
চলতি বছর মার্চেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ জন। মৃতের সংখ্যা ২। এপ্রিলে ৪২ জন আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা ২, মে মাসে কেউ মারা না গেলেও আক্রান্ত হয়েছেন ১৩৯ জন। পরিসংখ্যান বলছে যা গত দুই বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
মারাত্মক ডেঙ্গু না হলেও এরই মধ্যে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সেক্ষেত্রে ডেঙ্গুর বাহক মশা এডিস নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক হয়ে কাজ করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। পাশাপাশি ডেঙ্গু মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ার মানে এডিস মশার প্রকোপ বেড়েছে। এই প্রকোপ কমাতে হবে।
এদিকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানের কথা জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সর্বস্তরের সচেতনতার বিকল্প নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ডেঙ্গু মশা জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে বংশবিস্তার করে। নগরবাসী সচেতন হয়ে নিজেদের বাড়ির আশেপাশের জায়গা পরিষ্কার রাখতে পারলেই ডেঙ্গু থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকার কী করছে?: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে দেখা গেছে, দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার বেশি ঝুঁকিতে আছে ঢাকা দক্ষিণ। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১৫টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, উত্তর সিটি কর্পোরেশনে সাতটি ওয়ার্ডেও এ ঘনত্ব নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি।
এজন্য ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশনে মশা নিধন ও জনসচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন অভিনব কর্মসূচীর কথা শোনা গেছে। এর মধ্যে এডিস মশা ঠেকাতে গাপ্পী মাছের পোনা ড্রেনে ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এরপর এডিস মশা মারতে পুরুষ এডিস মশা আমদানির পরিকল্পনার কথাও শোনা গিয়েছিল।
কিন্তু এত কর্মসূচীর পরেও কেন ডেঙ্গুর প্রকোপ ঠেকানো যাচ্ছে না? জবাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন বলছেন, আমি বলবো ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। সাধারণত জুন মাস থেকে ডেঙ্গু মৌসুম শুরু হয়, অগাস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত এ মৌসুম চলে। সে অনুযায়ী জুন মাস থেকেই কাজ শুরু হবার কথা। ঈদের জন্য কিছুটা দেরি হয়েছে। এখন খুব দ্রুতই আবার কাজ শুরু হচ্ছে। আমরা সতর্ক আছি।
তবে মশা নিধন এবং মশার ওষুধের মান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ও অভিযোগ রয়েছে। সাঈদ খোকন বলেছেন, মশা ১০০ ভাগ নির্মূল হয়তো করা সম্ভব হবে না, তবে আমরা চেষ্টা করছি। আর মশার ওষুধের মান নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন থাকলেও আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনেই ওষুধ দিচ্ছি।
ডেঙ্গু জ্বর হলে যা করবেন : নানা সতর্কতার পরেও হয়তো ডেঙ্গুজ্বর হয়েই গেল! কেন এমন হলো- এমনটা চিন্তা না করে বরং দ্রুত চিকিৎসা নিন। আবার শুধু চিকিৎসা নিলেই হবে না, মেনে চলতে হবে কিছু নিয়মও। তাহলে খুব তাড়াতাড়িই আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
জ্বরের কারণে মুখের রুচি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর তাতে করে আপনার কোনো খাবার খেতে ইচ্ছে করবে না। তবুও দিনের শুরুটা তাজা ফলমূল দিয়েই সূচনা করবেন। ফলমূল থেকে প্রচুর শক্তি পাবেন। জুস না খেয়ে লেবু, আপেল ইত্যাদি ফল সরাসরি খাবেন। সকালের নাস্তায় সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাবার খাবেন।
ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুসারে ঔষধগুলো সঠিক সময়ে গ্রহণ করুন। ঔষধ কেনার সময় মেয়াদ দেখে নেবেন।
একবারে অনেক খাবার না খেয়ে অল্প অল্প করে বারবার খাবার খাবেন। ঔষধ খাবার সময়েও আপনার পেট ভরা রাখা জরুরি। এতে ভাইরাসের বিরুদ্ধে দ্রুত শরীর সক্রিয় হবে।
বেশি করে পানি পান করুন। ডাবের পানি, বাসায় তৈরি ফলের জুস, চিনি ও লবণ পানি বা স্যালাইন শরীরকে আর্দ্র রাখবে। কিছু সময় বা প্রতি ঘণ্টায় মুখ ভেজা রাখতে একটু একটু করে হলেও পানি পান করবেন। এতে শরীর থেকে টক্সিন বের হয়ে যাবে।
সারাক্ষণ পানীয় খাবার খেলে হয়তো ঝাল খাবার যেমন সমুচা, চিপস, স্পাইসি খাবার খেতে মন চাইবে। কিন্তু এসব খাবার ভুলেও খাবেন না। কারণ আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যথেষ্ট হয়নি। তবে শুকনো খাবারের ক্ষেত্রে কিসমিস ও খেজুর খাবেন।
রাতের খাবার খাওয়ার উত্তম সময় হবে আটটার পূর্বেই। এতে রাতের খাবার ও ঘুমের মাঝে পর্যাপ্ত সময় পাবেন। ফলে সহজে খাবার পাচিত হবে। এতে পেটের কোনো রোগ থাকলে তা কোনো জটিলতার সৃষ্টি করতে পারবে না।
অধিকাংশ লোকই বিভিন্ন ধরনের ঔষধ সেবনের ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন। এই সমস্যা থেকে বাঁচতে প্রচুর পরিমাণ আঁশযুক্ত খাবার ও তরল খাবার যেমন স্যুপ খান। তবে চা, কফি পান করবেন না।
কয়েকদিনের অসুস্থতায় আপনার দুর্বল লাগতে পারে। তাই প্রচুর বিশ্রাম নেবেন। এসময় ব্যায়াম করা থেকে বিরত থাকবেন। তবে বিশ্রামের পূর্বে কোনো ঔষধ খাওয়ার প্রয়োজন থাকলে খেয়ে নেবেন।
আপনার ঔষধের কোর্স সমাপ্ত হওয়ার পরও ডাক্তারের কাছে যাবেন। আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হলেও যাবেন। যদি আবারো রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে তবে পরীক্ষা করান। কারণ এই জ্বর আবারো ওঠার আশঙ্কা থাকে।
ডেঙ্গু জ্বরে আতংক না হয়ে ডাক্তারের কাছে যান। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সহজেই সুস্থ হওয়া যায়।

👁️ 4 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *