থামছেই না আহাজারি

জাতীয় জীবন-যাপন রাজধানী

সাততলা বস্তির আগুনে শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই: তদন্ত কমিটি গঠন


বিজ্ঞাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক : ভয়াবহ অগ্নিকান্ডস্থলে হাউমাউ করে কান্না আর আহাজারি করছিলেন এক মধ্যবয়স্ক নারী। তার আহাজারি আর কান্নায় মহাখালীর সাততলা বস্তি ভারি হয়ে উঠেছিল। তা দেখে অনেকেই চোখের পানি রাখতে পারেননি। ওই নারীর নাম সালেহা বেগম। আগুনে তার সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই।
তিনি টিভি চ্যানেল আর ফটো সাংবাদিকদের দেখে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, আমার মাইয়ার জামা-কাপড়, গহনা, টাকা-পয়সা সবকিছুই পুইড়া ছাই হইছে। শুধু তাই নয়, তার ঘরে ৩০ কেজি চাল, তেল, ডাল, টিভি-ফ্রিজ, আলমারিও পুড়ে সব কয়লা হয়ে গেছে। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচতে জানডা নিয়ে খালি হাতে বের হয়ে আইছি।
সালেহা বেগম জানান, তার স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে গত প্রায় দশ বছর ধরে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে বসবাস করছেন। তিনি এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করেন। আর তার স্বামী রাজধানীর একটি হোটেলে চাকরি করেন। সোমবার বেলা ১টা পর্যন্ত কেউ কোন খাবার বা সহায়তা দেননি। শুধু পানি খেয়েছিলেন।
অপরদিকে সকালে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বস্তির আগুন নেভানোর পরই সেখানকার বাসিন্দারা তাদের ঘরের মালামাল আছে কিনা তা দেখে ছুটে যান। তাদের সঙ্গে ছুটে যান সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী স্মৃতি আক্তার। সে তাদের ঘরে গিয়ে দেখেন, তার সবকিছু পুড়ে গেছে। তার পড়ার বইগুলোও পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। এসময় সে বইয়ের পোড়া কাগজ হাতে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। আর পোড়া বই হাতে তার বাবা শহীদুলকে স্মৃতি বলে, ‘আব্বু, আমার তো সব বই পুড়ে গেছে। ক্যামনে আমি পড়ুম? আমি পড়তে চাই। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা বলেন, ‘মা রে, যত কষ্টই হোক, আমি আবার তোমার বই জোগাড় করব। তুমি পড়বা, মা। স্মৃতি মহাখালীর সাততলা বস্তিতে তার মা-বাবা ও দুই ভাইবোনের সঙ্গে বস্তির একটি ঘরে থাকত। রোববার রাতে পড়াশোনা শেষে বইগুলো যতœ করে টেবিলে গুছিয়ে রেখে রাত ১০টায় ঘুমিয়ে পড়েছিল।
সোমবার ভোররাত চারটার দিয়ে আগুনের লেলিহান শিখা প্রথম স্মৃতির বাবা শহীদুল ইসলামের চোখে পড়ে। এরপর তিনি স্মৃতিকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সবার সঙ্গে রাস্তায় যায় স্মৃতি দেখে তাদের ঘর পুড়ছে। স্মৃতির তখন প্রথম মনে পড়ে তার পড়ার বইয়ের কথা। মনে পড়ে ঘরের সঙ্গে যে তার পড়ার বইও পুড়ছে। স্মৃতির বাবা আগে রিকশা চালাতেন, এখন তিনি হকার। গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধায়। মহাখালীর আমতলী হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। স্মৃতি আক্তারের সোহাগি নামে ছোট্ট একটা বোন আছে। সেও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। স্মৃতির ছোট ভাই রহমত উল্লাহ। তারা পড়াশোনা কীভাবে চালিয়ে যাবে সেটি নিয়েই চিন্তা তার।
সাততলা বস্তির বাসিন্দা সুফিয়া বেগম। তার ছোট বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আহাজারি আর কান্না করে দিকবিদিক ছুটাছুটি করছেন। ভোরের আগুনে গোছানো ছোট্ট সংসারের তার সবকিছুই পুড়ে গেছে। শুধু তাই নয়, তার স্বামীর সারাদিনের ঘামে ভেজা রোজগারের ৭শ’ টাকাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাদের বাড়ি গাইবান্ধার ভরতখালী এলাকায়। ৪ বছর ধরে মহাখালী সাততলা বস্তিতে স্বামী, শাশুড়ি আর সন্তানদের নিয়ে থাকছেন। সুফিয়া ও তার শাশুড়ি বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। আর স্বামী সাগর রিকশা চালান। রোববার ভোরে পাশের ঘরে আগুন আর ধোঁয়া দেখে বাচ্চা কোলে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে পড়েন সুফিয়া। তিনি জানান, তারা কিচ্ছু নিয়া বাইরাইতে পারি নাই। কোনো রকম জান নিয়ে বের হইছি। তার স্বামী কাল রাতে রিকসা চালিয়ে ৭০০ডা টাকা নিয়া আইছিল। তাও পুড়ে গেছে। শুধুই একটা গামছা নিয়ে তার স্বামী বের হয়েচে। সরকার থেকে পাওয়া ২০ কেজি চাল, ৬ কেজি তেল, কিচ্ছু নিতে পারি নাই। সব পুড়ে গেছে। শুধু সাগরের পরিবার নয়, সাততলা বস্তির সব হারিয়ে দেড় শতাধিক পরিবারের বেদনা-আহাজারি আর কান্নায় আকাশ- বাতাস ভারি হয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার ভোর ৩টা ৫৯ মিনিটের দিকে সাত তলা বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত। প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। আগুন ভয়াবহ রুপ নিতেই আরও চারটি ইউনিট যোগ দিয়ে একযোগে আটটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। পরে ভয়াবহ অগ্নিকা- সামলাতে যুক্ত হয় ফায়ার সার্ভিসের মোট ১৮টি ইউনিট। অগ্নিকা-ের আড়াই ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, অবৈধ গ্যাস ও বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে। বস্তিতে টিনের ঘর অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আমাদের ১৮টি ইউনিট কাজ করেছে। এখন পর্যন্ত আগুনে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে বলে আমরা ধারণা করছি। প্রচুর পরিমাণে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন রয়েছে। আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি, এই দুইটার থেকে যেকোনো কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. হাবিবুর রহমান, পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্ণেল জিল্লুর রহমানসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। উপ-পরিচালক জনাব নূর হাসান আহম্মেদকে সভাপতি, উপসহকারী পরিচালক আবুল বাশারকে সদস্য সচিব করে গঠিত তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সিনিয়র স্টেশন অফিসার, তেজগাঁ ফায়ার স্টেশন ও সংশ্লিষ্ট এলাকার দুজন ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টর।
উল্লেখ্য, এর আগেও পাঁচ বার পুড়েছে সাত তলা বস্তি। ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে এবং ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর রাজধানীর এ বস্তিতে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। প্রতিবারই গ্যাস নয়তো বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত।