অব্যাহতি চাওয়া সার্ভেয়ারকেই দেওয়া হলো জরিপের দায়িত্ব

অপরাধ এইমাত্র

লঞ্চ মালিকের হুমকি


বিজ্ঞাপন

বিশেষ প্রতিবেদক : আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকা স্বত্ত্বেও ত্রুটিপূর্ণ যাত্রীবাহী নৌযান ‘এমভি প্রিন্স অব সোহাগ’ তড়িঘড়ি বিক্রি করতে ফিটনেস সনদের জন্য বেপরোয়া তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী নৌযানটি জরিপ করা থেকে অব্যাহতি চাওয়া স্বত্ত্বেও তাকেই আবার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি, জাল ও ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে বছরের পর বছর অবৈধভাবে চলছে ‘এমভি প্রিন্স অব সোহাগ (এম-৬০৯৪)’ লঞ্চটি। যাত্রীবাহী নৌযানটির মালিক সৈয়দ জালাল উদ্দিন তিন বছর আগে মারা যাওয়ার পরেও বেআইনীভাবে চলেছে ঢাকার সদরঘাট থেকে চাঁদপুরের চরভোগ নৌরুটে। এমনকি অবৈধ উপায়ে এর ফিটনেসও সংগ্রহ করা হয়েছে। অথচ ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী মালিক বিহীন নৌযান চলাচল করতে পারে না। কিছু দিন আগে উত্তরাধিকার নির্ধারন করা হয়েছে।
অভিযোগ আছে, নৌযানটির বর্তমান কাঠামোর সঙ্গে অনুমোদিত নকশার কোনো মিল নেই। বেশকিছু কেবিন নতুনভাবে সংযোজন হয়েছে। এরমধ্যে ব্রিজ ডেকে নতুন কেবিন সংযোজন করায় নৌযানটি স্থায়িত্ব পরিবর্তন হয়েছে। তাছাড়া ঘোষণাপত্র অনুযায়ী নৌযানটিতে ব্রিজ অংশ-বিশেষ নেই। কাজ করে না এর রাডার অর্থাৎ সুকান। প্রায় নৌযানটির স্টিয়ারিং ফেইল করে। ইঞ্জিনরুমে কোনো যন্ত্রপাতির সেফটি সিস্টেম এমনকি সেফটি এলার্ম নেই। তাছাড়া ইঞ্জিনরুমে কাঠের পাটাতন ও তেল-মবিলদিয়ে ভরা থাকায় যেকোনো সময় অগ্নিদুর্ঘটনার আশংকা থেকে যায়। নৌযানটিতে নেই কোনো ফায়ার এলার্ম।
এছাড়া নৌযানটিতে যাত্রীসংখ্যা অনুযায়ী লাইফ জ্যাকেট ও বয়া নেই। যেগুলো আছে তার অধিকাংশ ছেঁড়া, ত্রুটিপূর্ণ ও ব্যবহার অযোগ্য। অন্যদিকে একটিমাত্র জেনারেটর থাকলেও সেটি ঘনঘন বন্ধ হয়ে যায়। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় যাতায়াতকারী যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
এদিকে ত্রুটিপূর্ণ ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের জরিপ করতে গিয়ে লঞ্চ মালিকের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে জাহাজ জরিপকারক এবং অভ্যন্তরীণ নৌযান রেজিস্ট্রারকে। হুমকির মুখে জরিপের দ্বায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে গত ৭জুলাই নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছেন ঢাকা সদরঘাটের প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক এবং অভ্যন্তরীণ নৌযান রেজিস্ট্রার মো. মাহবুবুর রশিদ।
প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারী কার্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী ও জাহাজ সার্ভেয়ারের কাছে অব্যাহতির আবেদন করেন তিনি। পত্রে মাহবুবুর রশিদ, ‘এমভি প্রিন্স অব সোহাগ’ সার্ভেকরণ থেকে অব্যাহতি প্রদানের অনুরোধ জানিয়েছেন। আবেদনে তিনি নৌযানটির নানা ত্রুটির কথা তুলে ধরে এর মালিক সৈয়দ মীর সোহাগ হোসেন মীর কর্তৃক নানা হুমকি, ভয়ভীতি এমনকি বাসায় গিয়ে উস্কানিমূলক আচরণে জানমালের এবং পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা ঝুকির বিষয়টি উল্লেখ করেন।
ঘটনার বর্ননা দিয়ে তাকে নৌযানটি জরিপের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদানের আবেদন করেন। আবেদনপত্র উল্লেখ করেন, ‘এমতাবস্থায় আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত থাকায় সব মিলিয়ে নৌযানটির বার্ষিক সার্ভে কার্যক্রম থেকে আমাকে অব্যাহতি প্রদান করতে বিনীত অনুরোধ করছি।’ এরপরেও তাকে জরিপের দায়িত্ব দেয়ার যৌক্তকতা সম্পর্কে তিনি কোন মন্তব্য করেননি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু জাফর মো. জালাল এ বিষয় প্রধান প্রকৌশলীর সাথে কথা বলতে বলেন।
নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মনজুরুল কবির নৌযানটির অনেক ত্রুটি থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত চলাচলের কোনো সুযোগ নেই। নৌযানটি জরিপের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদানের আবেদন করা মো. মাহবুবুর রশিদকে আবারও দায়িত্ব প্রদান করা বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিষ্ঠা ও সততার সাথে কাজ করার জন্যই তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
ঢাকা সদরঘাটসহ সারাদেশে নৌদুর্ঘটনার ঘটনা নতুন কিছু নয়। গত কয়েক বছরে নৌদুর্ঘটনা প্রাণ হারিয়েছেন শত শত মানুষ। এর মধ্যে বেশি কয়েকটি দুঘটনা আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দেয়। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগ নৌযানই ফিটনেসবিহীন।
এভাবে একের পর এক নৌদুর্ঘটনার পরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের টনক নড়ছে না। বরং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ত্রুটিপূর্ণ ও ফিটনেসবিহীন নৌযান চলছে অবাধে।
এসব নিয়ে তদারককারী সংস্থার ফাইল চালাচালির মধ্যে গত ৮ জুলাই সন্ধ্যায় আলোচিত নৌযানটি তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে সদরঘাট টার্মিনাল ত্যাগ করে। সূত্র বলছে, বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীনের কাছ থেকে সংক্ষিপ্ত অনুমতি নিয়ে সদরঘাট টার্মিনাল ত্যাগ করে।
এদিকে সম্মিলিত সামাজিক পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরাবর এক আবেদনে নৌযানটির নানা ত্রুটি, জালিয়াতি ও অসঙ্গতি তুলে ধরে এর সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন প্রদানের বৈধতার নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে অনিয়মরোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহনের অনুরোধ জানিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, নৌপরিবহন সচিব, নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন।
অন্যদিকে এমভি প্রিন্স অব সোহাগ যাত্রীবাহী নৌযান সম্পর্কিত একটি মামলা ঢাকা জর্জকোর্টে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় গোপনে বিক্রির প্রচেট বন্ধ করতে গত ২৬ আগস্ট জনৈক ফজলুল হক নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেছেন।