ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার যুবলীগ নেতা খালেদ বহিষ্কার

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র রাজধানী রাজনীতি

বিশেষ প্রতিবেদক : ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবে অবৈধ ‘ক্যাসিনো’র মালিক যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় যুবলীগ। শুক্রবার তাকে বহিষ্কার করা হয়।
ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হওয়া যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া এক সময় ছিলেন ফ্রিডম পার্টির কর্মী। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলাকারী ফ্রিডম মানিক ও ফ্রিডম রাসুর হাত ধরে তার রাজনৈতিক পথচলা। তার বেড়ে ওঠা রাজধানীর শাহজাহানপুরে,সেসময় বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ভাই মির্জা খোকনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবে ভোল পাল্টান দ্রুত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ভিড়ে যান যুবলীগে। শুরু করেন যুবলীগের রাজনীতি। খুব দ্রুতই দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর যুবলীগে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সময় নেননি খুব বেশি।আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, দলটির শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার আশীর্বাদ পেয়ে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির মাধ্যমে যুবলীগের ক্ষমতাধর নেতা হয়ে ওঠেন খালেদ মাহমুদ। প্রকাশ্যে এমন রাজনীতি করলেও অপরাধ জগতেও ছিল তার অবাধ বিচরণ। অভিযোগ রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়েও কাজ করতেন তিনি। বৈধ-অবৈধ অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতেন সবসময়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পরে যুবলীগের কিছু নেতার কর্মকা- নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর চার দিনের মাথায় র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হতে হলো তাকে।
খালেদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, মাদক, অস্ত্র আইন, অবৈধভাবে জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগে গুলশান ও মতিঝিল থানায় চারটি মামলা করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর দুই মামলায় ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় অবৈধ ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে বুধবার বিকেল চারটার দিকে গুলশানের বাসা থেকে যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। বৃহস্পতিবার দুপুরে তাকে গুলশান থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার আগে চারটি মামলা দায়ের করা হয়। গুলশান থানায় অস্ত্র, মানি লন্ডারিং ও মাদক মামলায় তিনটি ও মতিঝিল থানায় অবৈধভাবে ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করা হয়।
র‌্যাব, পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ তার রাজনৈতিক উত্থানের বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছে জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তাদের কাছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও অবৈধভাবে ক্যাসিনো পরিচালনা করে আয় করা অর্থ কোথায় কোথায় মাসোহারা হিসেবে দিতেন জানিয়েছেন সেসব তথ্যও। অবশ্য এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিস্তারিত কিছু জানাতে চাননি। তবে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন ধরে অপকর্ম করে আসছিলেন খালেদ। তার সঙ্গে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ দলটির অনেক নেতা যেমন জড়িত তেমনই এই তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের একাধিক মন্ত্রীও রয়েছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ছিল ক্ষমতাসীন দলে খালেদ মাহমুদের ‘রাজনৈতিক গুরু’। একসময় সম্রাটের অধীনস্ত হয়ে কাজ করলেও পাঁচ-সাত বছর ধরে তিনি নিজেই ক্যাডার বাহিনী নিয়ে চলাফেরা করতেন। তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা ছিল রাজধানীর মতিঝিল, শাহজাহানপুর, রামপুরা, সবুজবাগ, খিলগাঁও ও মুগদা। এসব এলাকার সবকিছুরই নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। যুবলীগ নেতা পরিচয়ে এসব এলাকায় থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রেল ভবন, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ওয়াসার ফকিরাপুল জোনসহ বেশিরভাগ সংস্থার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন খালেদ মাহমুদ। ভুঁইয়া অ্যান্ড ভুঁইয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। কমলাপুর এলাকায় এই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই বড় বড় টেন্ডার বাগিয়ে নিতেন খালেদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কুমিল্লার বরুড়া থানাধীন সরাফতি গ্রামে বাড়ি খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার। তার বাবার নাম আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া। অবশ্য কুমিল্লায় জন্ম হলেও তার বেড়ে ওঠা ঢাকার শাজাহানপুরে। ১৯৮৯ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালানো ফ্রিডম মানিক ও ফ্রিডম রাসুর হাত ধরে উত্থান হয় তার। সেসময় ফ্রিডম পার্টির কর্মী ছিলেন খালেদ। পরবর্তীতে ২০০১ সাল পরবর্তী চারদলীয় জোট সরকারের সময় তিনি ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সেসময় তিনি বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ভাই মির্জা খোকনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। খিলগাঁও-শাজাহানপুর এলাকায় সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ হিসেবে পরিচিতি ছিল তার। শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিকের হয়ে সে এলাকায় চাঁদাবাজি করতো। হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে পড়াশোনা করার সময় তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে পুলিশের সঙ্গে তার সংঘর্ষ বাধে। এসময় পুলিশের গুলিতে তার একটি পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন থেকেই তাকে ল্যাংড়া খালেদ নামে অনেকে চেনে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১০ পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয় সে। ২০১৩ সালে বিশাল শোডাউন করে সে যুবলীগে যোগদান করে। সাধারণ সদস্য পদ না থাকলেও অর্থের বিনিময়ে সে সরাসরি সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পায়।এরপর থেকেই আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে খালিদ। মতিঝিল এলাকার সকল চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি একসময় নিয়ন্ত্রণ করতো মিল্কী, তারেক ও চঞ্চল। ২০১৪ সালে মিল্কী খুন হওয়ার পর ক্রসফায়ারে মারা যায় তারেক। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় চঞ্চল। এরপর পুরো ফাঁকা মাঠের দখল নেয় খালেদ।
সূত্র জানায়, যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটের সঙ্গে লিয়াজোঁ ঠিক রেখে সবকিছু করতেন খালেদ। মতিঝিল এলাকার জুয়ার আসরগুলো নিয়ন্ত্রণে নেন নিজের হাতে। এরই মধ্যে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির করতে গিয়ে তার সঙ্গে সখ্য হয় দুবাইয়ে পলাতক থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে। জিসানের সঙ্গে গত কয়েক বছর একসঙ্গে কাজ করলেও সম্প্রতি তার সঙ্গেও বিরোধ শুরু হয়। একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে নিজের পূর্ণাঙ্গ বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। একাধিক অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল তার। এছাড়া তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের কাছে অবৈধ অস্ত্রও রয়েছে অনেক। চলাফেরা করার সময় বিশাল ক্যাডার বাহিনী নিয়ে চলাফেরা করার অভিযোগও রয়েছে গ্রেফতার হওয়া খালেদের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খিলগাঁও-শাহজাহানপুর হয়ে চলাচলকারী লেগুনা ও গণপরিবহন থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন খালেদ। প্রতিবছর কোরবানির ঈদে শাহজাহানপুর কলোনি মাঠ, মেরাদিয়া ও কমলাপুর পশুর হাট নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। খিলগাঁও রেল ক্রসিংয়ে প্রতি রাতে মাছের একটি হাট বসিয়ে চাঁদা নিতেন যুবলীগের এই নেতা। খিলগাঁও কাঁচাবাজারের সভাপতিও সে। তার বিরুদ্ধে শাহজাহানপুরে রেলওয়ের জমি দখল করে দোকান ও ক্লাব বানানোর অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, গত ৩-৪ বছর ধরে খালেদের উত্থান হয়েছে বেশি। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে চলতো সে। একারণে এর আগে কেউ ঘাঁটায়নি তাকে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণেই তার বিষয়টি সামনে এসেছে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *