ছদ্মবেশী বিপ্লবী! স্বৈরাচারের দোসর থেকে রাতারাতি ‘বিরোধী’ সেজেছেন গণপূর্তের বিতর্কিত প্রকৌশলী আবু সায়েম জুয়েল  : ছাত্রলীগ ক্যাডার থেকে কোটি টাকার ‘ডিপ্লোমা ডন”

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী রাজনীতি সংগঠন সংবাদ সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক  :  বদলে যাওয়া মুখ, কিন্তু বদলায়নি চরিত্র!স্বৈরাচার সরকারের ১৬ বছরের দোসর,পূর্ত অধিদপ্তরের বিতর্কিত উপসহকারী প্রকৌশলী এ এস এম আবু সায়েম জুয়েল, এখন হঠাৎই নিজেকে আওয়ামী বিরোধী বলে দাবি করছেন।  গত বছরের ৫ আগস্টে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন সংগ্রামের ফলে সাবেক আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার পতনের পর থেকে তার আচরণে নাটকীয় পরিবর্তন—যেন কালো পোশাক খুলে নীল জামা পরে ইতিহাস মুছে ফেলতে চান তিনি। অথচ ছিলেন বংগবন্ধু পিডব্লিউডি ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পরিষদ এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ৪ জানুয়ারি ২০১৭ নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেন, “ভালোবাসার নাম ছাত্রলীগ। জয় বাংলা।” ১২ মে, ২০১৮ লিখেছেন, “বিজয় আমাদের অধিকার। জয় বাংলা, জয় বংগবন্ধু।”


বিজ্ঞাপন

ছাত্রলীগ ক্যাডার থেকে কোটি টাকার ‘ডিপ্লোমা ডন’  : ২০০৬ সালেচাকরিতে যোগ দেওয়া আবু সায়েম জুয়েল ছাত্রজীবনে ছিলেন একসময়ের কুখ্যাত ছাত্রলীগ ক্যাডার। চাকরির শুরুর পর থেকেই ঢাকার বিভিন্ন ডিভিশনে ঘুরেফিরে থেকে গড়ে তোলেন ক্ষমতা ও প্রভাবের এক অদ্ভুত সাম্রাজ্য। গণপূর্তের অফিস করিডর, ঠিকাদারদের চেম্বার, এমনকি মন্ত্রণালয়ের কক্ষেও তার নাম উচ্চারিত হতো ভয় আর বিতৃষ্ণার সঙ্গে। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে দীর্ঘ ২০ বছরে ঢাকায় তিনি জমিয়েছেন গাড়ি, বাড়ি, প্লট, এপার্টমেন্ট—সব মিলিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকার সম্পদ, যার বেশির ভাগই নামে–বেনামে।

প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় “সায়েম সাম্রাজ্য”  :  নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়—তোফায়েল আহমেদ ও আমির হোসেন আমুর আত্মীয় পরিচয় দেখিয়েতিনি স্বৈরাচার সরকারের আমলে পূর্ত প্রশাসনে ছিলেন এক ‘অঘোষিত সম্রাট’। উর্ধ্বতনদের হুমকি, সহকর্মীদের গালি—সবই ছিল তার দৈনন্দিন রুটিন। একাধিক ডিপ্লোমা প্রকৌশলী জানিয়েছেন, “তার হাতে পড়লে গালাগালি না খেয়ে বাঁচা যেত না; কেউ প্রতিবাদ করলেই বদলি বা হয়রানি।” এমনকি কয়েকজন প্রকৌশলী শারীরিক নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন তার হাতে।


বিজ্ঞাপন

বদলির নাটক ও প্রভাবের প্রদর্শনী :  গত ৩ জুলাই প্রধান প্রকৌশলীর স্বাক্ষরিত আদেশেজুয়েলকে ঢাকা ৪নং গণপূর্ত বিভাগের অধীনে রেলওয়ে ডাইভারশন উপবিভাগে বদলি করা হয়। কিন্তু তা নিয়েও শুরু হয় নাটক। অধিদপ্তরজুড়ে ছড়ায় আলোড়ন। যেখানে একাধিক উপসহকারী প্রকৌশলীকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছে, সেখানে জুয়েল শুধু এক সেকশন থেকে অন্য সেকশনে স্থানান্তরিত হয়ে “ঢাকাতেই” থেকে যান! বিভিন্ন সূত্র বলছে, এই বদলির পেছনে হাত ছিল ছাত্র উপদেষ্টা হাসনাত আব্দুল্লাহর শ্বশুরের। এমনকি একজন জামায়াত নেতার সুপারিশও তার পক্ষে যায় যা এখন পুরো অধিদপ্তরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।


বিজ্ঞাপন

“নৌকা ব্যাজ” থেকে “জামায়াত জার্সি”  :  ছাত্রজীবনেবঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পরিষদের নেতা ছিলেন জুয়েল। গলায় ট্যাগ, বুকে নৌকা ব্যাজ লাগিয়ে মন্ত্রণালয়ে ঘুরতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর মাজারে সরকারি সফর মানেই তার উপস্থিতি অবধারিত ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে সেই আওয়ামী প্রভাবশালী প্রকৌশলীই এখন হঠাৎ হয়ে উঠেছেন “বিরোধী দলের সৈনিক”! ৫ই আগস্টের পর থেকে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরোধী সেজে নিজের অতীত মুছে ফেলতে মরিয়া।

ঢাকায় লুটপাটের ‘হিসাব বই’  :  সচিবালয় ও মিরপুর ডিভিশনে শাখা কর্মকর্তা থাকাকালে ঠিকাদারদের কাছে তার একটাই বার্তা ছিল “কাজ শেষ, এখন টাকা দে, বিল নে।” চুক্তিমূল্যের ৫৫%/৬০% টাকা নিজের পকেটে নিতেন তিনি। প্রায় সাত বছর মিরপুরে থেকে পাইকপাড়া ও শিয়ালবাড়ি এপার্টমেন্ট প্রকল্পে কাজ না হয়েও অগ্রিম বিলের নামে কোটি কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ভ্যারিয়েশন দেখিয়ে নিজের লোকের ঠিকাদারি ফার্মের মাধ্যমে কাজ করিয়ে মোটা অংকের কমিশনও পেতেন।

মুগদা, ডেমরা ও রেলওয়ে প্রকল্পে নতুন ‘খেলা’  :  বর্তমানে তিনি রেলওয়ে ডাইভারশন উপবিভাগের ২নং শাখায় দায়িত্বে আছেন, যেখানে চলছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডিএমপি ডেমরা পুলিশ লাইনসহ তিনটি বড় প্রকল্পের কাজ। আরও দুইটি বড় প্রকল্প তার হাতে আসার অপেক্ষায়। সূত্র বলছে, এসব পোস্টিং তিনি পেয়েছেন “ভারি অংকের তদবিরের বিনিময়ে” যার পেছনে লক্ষ্য একটাই, আগের মতোই কমিশন বাণিজ্য।

আন্দোলনে ক্যাডার অর্থায়ন :  ২০২৪ সালে ছাত্র জনতার আন্দোলন দমনেও তার ভূমিকা ছিল কুখ্যাত। রামপুরা, বনশ্রী ও খিলগাঁও এলাকায় ছাত্রলীগ ক্যাডারদের অর্থায়নে প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয় করেন তিনি, এমনটাই জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য সূত্র।

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে  :  আজ যখন ক্ষমতার পালাবদলের হাওয়া বইছে, তখনই আবু সায়েম জুয়েল হঠাৎ ‘আওয়ামী বিরোধী’ সাজতে শুরু করেছেন। যে মানুষটি একসময় নৌকার ব্যাজ বুকে গর্বে ঘুরতেন, এখন তার মুখে ‘বিরোধী চেতনা’র বুলি। অথচ গণপূর্তের সাধারণ প্রকৌশলীরা জানেন এই ভোলবদল আসলে আত্মরক্ষার অভিনয়, অতীত পাপ ঢাকার চেষ্টা।

বক্তব্য জানতে ফোন করলে…সব অভিযোগের বিষয়েজানতে তার মোবাইলে ফোন দিলে সাংবাদিক পরিচয় শুনেই তিনি লাইন কেটে দেন, পরে আর সাড়া দেননি।

শেষকথা: মুখ বদলেছে, মন বদলায়নি :  চেহারায় নতুন মুখোশ, হাতে পুরনো খেলা। স্বৈরাচারের দোসর থেকে হঠাৎ বিরোধী সেজে ইতিহাস পাল্টাতে চাইলেও গণপূর্ত অধিদপ্তরের করিডরে সবাই জানে এ এস এম আবু সায়েম জুয়েল এখনো সেই পুরনো চরিত্রেরই ধারক। একজন উপসহকারী প্রকৌশলী হয়েও তিনি যেন এক পুরো দপ্তরের ‘অঘোষিত রাজা’।

👁️ 118 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *