১১ বছরের গোপন সাম্রাজ্য : পদোন্নতির আড়ালে গণপূর্তের ‘অঘোষিত ঠিকাদার’ রাকিবুলের কোটি টাকার লুট-কারসাজির বিস্ফোরক তদন্ত

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক :  রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ১৭ নভেম্বর প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে মো. রাকিবুল হাসানের নির্বাহী প্রকৌশলী পদে পদোন্নতির খবর প্রকাশের পর গণপূর্ত অধিদপ্তরে ছড়িয়ে পড়ে অভূতপূর্ব তোলপাড়। কারণ, যাঁকে রাষ্ট্রীয় ‘বিশ্বাস’ দিয়ে উচ্চ পদে উন্নীত করা হলো, ঠিক সেই ব্যক্তি গত ১১ বছর ধরে সরকারি চাকরি করে নিজেই ঠিকাদারি ব্যবসা চালিয়ে কয়েকশো কোটি টাকার অনিয়ম, কমিশন বাণিজ্য ও প্রকল্প লুটপাটের অভিযোগে জর্জরিত।


বিজ্ঞাপন

এ যেন “প্রকৌশলী” নয়—গণপূর্তের ভেতরে গোপনে বেড়ে ওঠা একটি সমান্তরাল ঠিকাদারি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।

দুটি পরিচয়, দুই জীবন—দিনে কর্মকর্তা, রাতে ঠিকাদার : গণপূর্তের একাধিক কর্মকর্তা ও ঠিকাদার সরাসরি দাবি করেছেন—“রাকিবুল হাসান প্রকৃতপক্ষে দুই পরিচয়ের মানুষ। অফিসে সরকারি প্রকৌশলী, আর অফিসের বাইরে তিনি ঠিকাদার সিন্ডিকেটের মস্তিষ্ক।”


বিজ্ঞাপন

তাদের কথায় উঠে আসে আরও ভয়াবহ চিত্র— প্রকল্পের কমিশন না দিলে ফাইল আটকে দেওয়া, মাপজোখে জটিলতা তৈরি করে ঠিকাদারকে জিম্মি করে রাখা, রাজনৈতিক নাম ব্যবহার করে চাপ প্রয়োগ এবং সিন্ডিকেটের নির্দেশে টেন্ডার ‘বন্দোবস্ত’ করে দেওয়া।


বিজ্ঞাপন

এই পুরো অপারেশনের পেছনে রয়েছে দু’জন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও অন্তত এক ডজন নির্বাহী প্রকৌশলীর একটি অন্ধকার সিন্ডিকেট, যার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে রাকিবুল হাসান।

টেন্ডার বাণিজ্যের পর্দা উন্মোচন: “নিজেদের ঠিকাদার” ছাড়া কেউ সুযোগ পায়নি : সাম্প্রতিক কয়েকটি প্রকল্পে দেখা যায়, টেন্ডার ওঠার আগেই ঠিকাদাররা জানতেন—কারা কাজ পাবে, আর কারা পাবে না।

সবকিছুর নেপথ্যে রাকিবুল :  একজন ঠিকাদার বলেন—“ওঁর এলাকায় কাজ করতে হলে কমিশন দিতে হতো, না হলে ফাইলই নড়ত না। আর সরকারি নিয়ম ভেঙে তিনি নিজেই ঠিকাদারি করতেন। আমরা নাম দিলেও টেন্ডারে সুযোগ পেতাম না।”

তেজগাঁও গণপূর্ত উপবিভাগে দায়িত্ব পালনকালে তিনি নাকি কোনো বাইরের ঠিকাদারকে সুযোগই দেননি। অভিযোগকারীরা বলেন—“যেখানে তার স্বার্থ, সেখানে তিনিই ঠিকাদার।”

২০ কোটি টাকার ভুয়া ভেরিয়েশন, ২ কোটি টাকার কমিশন—“এটা কেবল সামান্য অংশ” : টেন্ডার বাণিজ্যের বরফগলা অংশ প্রকাশ হয়েছে একটি ঘটনায়—ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দেশ উন্নয়ন-এর বিল ছাড় করতে ২০ কোটি টাকার ভুয়া ভেরিয়েশন দেখিয়ে রাকিবুল হাসান নাকি ২ কোটি টাকা কমিশন নিয়েছেন।

তেজগাঁও বিসিক ভবনের বেজমেন্টে গুরুতর ত্রুটি ধরা পড়লেও তিনি মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কুশলী নির্মাতা–কে ছাড়পত্র দেন। অভিযোগকারীদের ভাষায়— “রাকিবুলকে ৫% কমিশন দিয়ে তারা সম্পূর্ণ বিল তুলেছে।”

শত কোটি টাকা লোপাট—ঢাকা, কুমিল্লা, গাজীপুরে বিলাসী সাম্রাজ্য : অভিযোগ রয়েছে—তেজগাঁও শিল্প প্লট ও উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাকিবুল হাসান অন্তত শত কোটি টাকা লোপাট করেছেন।

এই অর্থ প্রবাহ গেছে নানা পথে—এর মধ্যে ঢাকায় মূল্যবান জমি ও ফ্ল্যাট, কুমিল্লা শহরে ১০ কাঠা জমি, গাজীপুরে ৩০ একর জমিতে বিলাসবহুল রিসোর্ট নির্মাণ এবং বিদেশে অর্থপাচার—সিঙ্গাপুরে কয়েকশো কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানোর গুঞ্জন।

গণপূর্তের এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন—“রাকিবুল এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, এখন ওকে না খুশি করে কোনো প্রকল্পই এগোয় না।”

প্রেসক্লাবে মানববন্ধন  ও  দস্যু প্রকৌশলীকে’ তদন্তের আওতায় আনার দাবি :  গত ১০ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে রাকিবুলের বিরুদ্ধে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিক ঠিকাদার মানববন্ধন করে বিস্ফোরক সব অভিযোগ করেন।

তাদের বক্তব্য—“সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি ১১ বছর ধরে ঠিকাদারি ব্যবসা করছেন। কমিশন না দিলে ফাইল আটকে রাখেন, আর কমিশন দিলে নিম্নমানের কাজও পাস হয়ে যায়। তিনি গণপূর্তের কালো সিন্ডিকেটের কেন্দ্রবিন্দু।”

অফিসে নেই, ফোন বন্ধ—রাকিবুল ‘উধাও’ : এ সমস্ত অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য নিতে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়—তিনি সেদিন অফিসেই আসেননি।

প্রধান প্রকৌশলী: “অনিয়ম বরদাস্ত করা হবে না” : গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী জানতে পেরে প্রতিবেদককে রবিবার অফিসে এসে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নিতে বলেন এবং সংক্ষেপে মন্তব্য করেন—“এ ধরনের অনিয়ম কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।”

উপসংহার : পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গেই ফেটে পড়ল ‘গণপূর্তের গোপন ক্যানসার’, রাকিবুল হাসানকে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেওয়ার পরই তার বিরুদ্ধে বছরের পর বছর চাপা থাকা দুর্নীতি, গোপন ঠিকাদারি, সিন্ডিকেট বাণিজ্য এবং শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগগুলো আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।

এখন প্রশ্ন একটাই—এত শক্তিশালী সিন্ডিকেটের ভিত ভেঙে একজন রাকিবুল হাসানের বিরুদ্ধে সত্যিকারের তদন্ত—কেউ কি করতে পারবে?

👁️ 171 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *