
নিজস্ব প্রতিবেদক : স্বাস্থ্য খাতের মতো স্পর্শকাতর একটি খাতে বরাদ্দ ছিল ৭৮ লাখ টাকা। উদ্দেশ্য—সরকারি হাসপাতালগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। মাঠে কাজের কোনো দৃশ্যমান উপস্থিতি নেই, অথচ পুরো টাকার বিল উত্তোলন সম্পন্ন! এই ভয়াবহ অনিয়মকে কেন্দ্র করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের শেরে বাংলা নগর বিভাগ–২–এর নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম এখন তীব্র বিতর্কের কেন্দ্রে।

তিন হাসপাতাল, এক গল্প—কাজ নেই, কাগজে সব শেষ : অভিযোগ অনুযায়ী, রাজধানীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজের জন্য এই অর্থ বরাদ্দ ছিল—শ্যামলীর ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতাল, মোহাম্মদপুরের ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার, ১০০ শয্যার মা ও শিশু হাসপাতাল, বরাদ্দ পাওয়ার পর অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। তারপর কাজ শেষ হয়েছে—এমন দেখিয়ে জুন মাসের মধ্যেই পুরো অর্থের বিল পরিশোধ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এই হাসপাতালগুলো ঘুরে দেখা গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র।
২০–৩০ শতাংশ কাজ, কোথাও শূন্য—তবু বিল শতভাগ : গণপূর্ত অধিদপ্তরের ভেতরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান—কোথাও মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কাজ হয়েছে, কোথাও শ্রমিকের কোনো অস্তিত্বই ছিল না, কোথাও পুরোনো ভাঙা অবকাঠামো অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়ে গেছে, অথচ কাগজে-কলমে দেখানো হয়েছে—সব কাজ সম্পূর্ণ, মানসম্মত ও ব্যবহারযোগ্য।

LTM পদ্ধতির আড়ালে ঠিকাদার সিন্ডিকেট ? : তদন্ত সংশ্লিষ্টদের দাবি, অধিকাংশ কাজ দেখানো হয়েছে LTM (Limited Tendering Method) পদ্ধতিতে। অভিযোগ রয়েছে—এক বা দুইজন একই ঠিকাদার বারবার কাজ পেয়েছেন ওই ঠিকাদাররা নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বলয়ের অংশ, সরকারি ক্রয়বিধি (PPR) অনুযায়ী পর্যাপ্ত প্রতিযোগিতা না থাকলে দরপত্র বাতিল করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও, এখানে তা মানা হয়নি বলেই অভিযোগ।

কাজের আগেই বিলের কাগজ! পরিকল্পিত আত্মসাৎ ? অভিযোগ আরও ভয়াবহ রূপ নেয় যখন জানা যায়— কাজ শেষ হওয়ার আগেই পরিমাপপত্র (MB), প্রত্যয়নপত্র ও বিল সংক্রান্ত কাগজপত্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ মাঠে কাজ থাকুক বা না থাকুক, কাগজে সব কিছু আগেই ‘ম্যানেজ’ করা। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ভাষায়, এটি কোনো সাধারণ অনিয়ম নয়—সরকারি অর্থ আত্মসাতের একটি সুপরিকল্পিত ছক।
প্রভাবশালী যোগাযোগের ‘ঢাল’, দেখালেন প্রকৌশলী?
অভিযোগ প্রসঙ্গে নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার দাবি— সব কাজ নিয়ম মেনেই হয়েছে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হওয়ার পরই বিল দেওয়া হয়েছে।
তবে অভিযোগ রয়েছে, নিজের অবস্থান শক্ত করতে তিনি বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা উল্লেখ করেছেন—প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও তার মামা হাদী এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম, তথ্য উপদেষ্টা কার্যালয়সহ এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ঘনিষ্ঠজন থাকার কথাও তিনি বলেছেন—এমন অভিযোগ উঠেছে।
তদন্তকারীদের সাফ কথা : ‘মাঠে কাজ নেই, কাগজে সব আছে’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব দাবিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাদের বক্তব্য— বাস্তবে কাজ না থাকলেও কাগজপত্র নিয়ন্ত্রণ করে পুরো অর্থ ছাড় করানো হয়েছে, যা সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনার চরম লঙ্ঘন।
আইন কী বলে ? : সরকারি বিধি অনুযায়ী—কাজ না করে বা অসম্পূর্ণ কাজ দেখিয়ে বিল উত্তোলন ফৌজদারি অপরাধ, দরপত্রে প্রতিযোগিতা না রাখা, একই ঠিকাদারকে বারবার কাজ দেওয়া, সিন্ডিকেট গঠন ‘ এসব অপরাধ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হতে পারে—বিভাগীয় ব্যবস্থা, সাময়িক বরখাস্ত, আর্থিক জরিমানা, আত্মসাৎ করা অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত, ব্যবস্থার ব্যর্থতা, শুধু একজনের নয়, সচেতন নাগরিক ও স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, অভিযোগ সত্য হলে এটি শুধু একজন প্রকৌশলীর দায় নয়—পুরো ব্যবস্থার ব্যর্থতার নগ্ন চিত্র। তারা নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
শেষ প্রশ্ন : ৭৮ লাখ টাকার কাজ না করেই যদি বিল তুলে নেওয়া যায়, কাগজে উন্নয়ন দেখিয়ে মাঠে শূন্যতা তৈরি করা যদি নিয়মে পরিণত হয়—তাহলে প্রশ্ন একটাই—এটাই কি এখন রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের নতুন মডেল? এই প্রশ্নের জবাব এখন দেশের মানুষ জানতে চায়।
