করোনা : অরক্ষিত বস্তিবাসী

জাতীয় জীবন-যাপন রাজধানী স্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক : কাঠ, বাঁশ আর টিনের ছোট ছোট খুপরি। গায়ে গা লাগানো খুপরির সারি। মাঝখানে আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা। রাস্তার ওপরেই মাটির জ্বলন্ত উনুন। অলিগলি জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো ময়লা। দুর্গন্ধময় টয়লেট। খোলা গোসলখানার টিউবওয়েলের পাশেই আবর্জনার স্তূপ-এমনই দৃশ্যপট নগরীর প্রতিটি বস্তির। এখানে একেকটি খুপরিতে গাদাগাদি করে থাকে নিম্ন আয়ের মানুষ।
এসব বস্তির বাসিন্দাদের নারী সদস্যরা বেশিরভাগ ছোটা গৃহকর্মী। অন্যের বাড়ির পরিচ্ছন্নতার কাজটিও করেন তারা। বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যে সামাজিক দূরত্বের কথা বলা হচ্ছে, কিংবা জীবাণুমুক্ত থাকতে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার যে কথা, তা কতটুকু সম্ভব হচ্ছে এসব বস্তিতে?
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইসিডিআর) বলছে, দেশে ইতিমধ্যে সীমিত আকারে করোনাভাইরাসের সামাজিক বা গণসংক্রমণ শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ঘনবসতির এই বস্তিগুলো একদমই অরক্ষিত।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন নির্দেশনা খেটে খাওয়া মানুষগুলোর জন্য যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া। বাইরেও বেরোতে পারছে না, আবার একসঙ্গে গাদাগাদি করে অবস্থান। তবে তাদের অনেকের বিশ্বাস, করোনায় আক্রান্ত তো দূরের কথা কিছুই হবে না তাদের। সারাদিন কাজ করতে গিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মধ্যে থাকেন তারা। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরের ভাসানটেক বস্তি ঘুরে দেখা গেছে, করোনার নাম না জানলেও একটা ভাইরাস এসেছে দেশে এ বিষয়ে জানে অনেকেই। কিন্তু এই বিপদ ঠেকাতে করণীয় সম্পর্কে জানা নেই তাদের।
মাজেদা বেগম নামের এক নারী বলেন, শুনছি একটা ভাইরাস আইছে। নাম নাকি করন্না। তয় পয়পরিষ্কার থাকলে নাকি ওই রোগ অয় না। আমাগো আর চিন্তা কী! আমরা তো পয়পরিষ্কারই থাকি।
মিজান মিয়া কথা বলার আগ্রহে পাশ থেকে উঁকি দিচ্ছেন। করোনাভাইরাস সম্পর্কে তিনি শুনেছেন। কিন্তু এর লক্ষণ-উপসর্গ কিংবা করণীয় কিছুই জানেন না। বলেন, কয়দিন হইলো মাথাব্যথা। আমার কি করন্না হইছে? এ নিয়ে চিন্তিত তিনি।
বিভিন্ন বাসায় যারা কাজ করেন, গৃহকর্ত্রীর ঘন ঘন হাত ধোয়ার ঘটনায় অবাক বনে যান অনেকে। তাদেরও বারবার হাত ধোয়ার তাগাদা দেন গৃহকর্ত্রী। এতে বিরক্ত হন অনেকে। তাদের ভাষ্য থেকে জানা গেল, গৃহকর্মীকে হাত ধোয়ার কথাও বললেও আর কোনো সচেতনতামূলক নির্দেশনা দেন না গৃহকর্ত্রীরা।
কী কারণে হঠাৎ এত হাত ধুতে হবে তার কারণ জিজ্ঞেস করেননি কেউই। গৃহকর্মী জুলেখা আক্তার বলেন, আফায় খালি হাত ধুইতে কয়। কেন কয় জানি না। একটা ডিব্বায় টিপ দিলে সাবান বাইর হয়, এইটা দিয়া হাত ধুই। আর কাপড়চোপড় ভালো কইরা ধুইয়া পরতে কয়।
গৃহকর্মী রিনা বলেন, ভাইরাস আইছে। মালিকরা সাবধানে থাকতে কয়।
প্রৌঢ়া জেবুন্নেসা খাতুনও গৃহকর্মীর কাজ করেন। করোনাভাইরাসে বৃদ্ধদের ঝুঁকি বেশি এমন কথাই শুনছেন তিনি। বলেন, বয়স্ক গো নাকি এই রোগে বেশি ধরে। খালি হাত ধুইতে আর পরিষ্কার থাকতে কয়।
কাজের খোজে নগরীতে আসা এই মানুষগুলো কাজ পেলেও অভ্যাসের পরিবর্তন হয় না তাদের। ঘনবসতি হলেও সবাই সবার ঘর ও আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখলে যেকোনো রোগ প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ডাক্তার এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, বস্তিতে যারা থাকেন, এই করোনার সময় খুবই পরিষ্কার রাখতে হবে। ময়লাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে না রেখে এক জায়গায় ফেলতে হবে। নখ কেটে রাখতে হবে সব সময়। আগে গরম পানি দিয়ে বাসন ধুয়ে নিতে হবে। চেষ্টা করতে হবে সাবান দিয়ে কাপড়-চোপড় ভালোভাবে পরিষ্কার করতে। কষ্টকর হলেও পরিষ্কার থাকার অভ্যাসটা তৈরি করতে হবে।
তবে করোনায় যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার কথা বলা হচ্ছে সেটা ঘনবসতির মানুষগুলো মেনে চলবে কীভাবে। সুরত আলী নামের একজন বললেন, আমরা দূরে দূরে থাকুম কেমনে! ছোট্ট খুপরিতে সবাই একসঙ্গে থাকি। আর অখন তো বস্তির বাইরেও যাওন যায় না। এই ভাইরাস একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে যায়- এমনটা শুনেছেন তিনি।
সুরত আলী লোকমুখে করোনাভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ-উপসর্গের হিসেবে সর্দি-কাশির কথা শুনেছেন। কিন্তু তার ভাষ্য, ‘বস্তিতে তো সব সময় সর্দি-কাশি লেগে থাকে। কেমনে বুঝব কোনটা করোনা। দেশজুড়ে যদি গণসংক্রমণ হয় তাহলে ঘনবসতির এই অরক্ষিত বস্তির মানুষরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম।
ড. মঈনুল বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নি¤œবিত্তের মানুষ, বিশেষ করে বস্তির মানুষেরা। একে তো খাবার সংকটে থাকবে, পাশাপাশি সচেতনতার অভাবের তারা বুঝতেই পারবে না যে তাদের কোভিড-১৯ হয়েছে কি না। আর লক্ষণ বুঝে তারা কখনোই আইইডিসিআরকে কল করবে না।
সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন এবং লোকাল গভর্মেন্টের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে বলে মত দেন ড. মঈনুল।
বস্তির অনেকের হাতেই রয়েছে স্মার্টফোন। করোনাভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারণা শুনতে পেলেও সাধ ও সাধ্যের পার্থক্য তাতে বড় বাধা। হাত ধোয়ার জন্য নেই পর্যাপ্ত পানি। নেই সাবান কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এ ছাড়া পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি জীবিকার সন্ধানে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয় বলে।
মেয়ের মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে সুফিয়া বানু বলেন, এত কিছু করোমু কহন? সব আল্লায় ঠিক কইরা দিব।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা তাজিনা সারোয়ার। তিনি বলেন, করোনার সময়গুলোতে বস্তিগুলো পরিচ্ছন্ন রাখা ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের সচেতন করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সচেতনতার জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর সেগুলো সমন্বয় করবেন।
প্রতি ওয়ার্ডে বিশেষ করে বস্তি এলাকায় ১০টি করে বেসিন স্থাপনের জন্য নির্দেশনা পেয়েছেন বলে জানান উত্তর সিটির বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, রাস্তায় তো ওষুধ ছিটিয়ে ধোয়া হচ্ছে। কিন্তু বস্তির ভেতরে আমাদের গাড়ি যেতে পারে না। তবে সেগুলোতেও স্যানিটাইজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইড মিরপুর ও কড়াইলের প্রায় ২৭টি জায়গায় বেসিন বসিয়েছে। সচেতনতার জন্য তারা ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছে।
ভাসানটেকের ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সালেক মোল্লা বলেন, ওরা গরিব মানুষ। আমরা চেষ্টা করছি তাদেরকে সচেতন করতে এবং তাদের এলাকাটা পরিষ্কার রাখতে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *