বিপিএমসিএতে ফ্যাসিবাদের ভূত ; নির্বাচনী ফলাফল বাতিলের ষড়যন্ত্র !

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সংগঠন সংবাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক  : বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ) বিগত ১৬ বছরের অনির্বাচিত ও এক তরফা ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ও তহবিল তছরুপের অভিযোগ উঠেছে। বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার সাথে জড়িত মালিকদের এই সংগঠনের মধ্যে স্বজনতোষণ, নিয়মনীতি লঙ্ঘন ও বছরের পর বছর অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে বিধিবহির্ভূতভাবে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা সংগঠনটির সাধারণ সদস্যদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে এটিকে পকেট সংগঠনে পরিণত করেন বলে অভিযোগ।


বিজ্ঞাপন

প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বিপিএমসিএ ২০১০ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জয়েনস্টক কমিশন থেকে নিবন্ধন নিয়ে অরাজনৈতিক সংস্থা হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। সংগঠনটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২১ সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটির প্রতি দু’বছর অন্তর নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনির্বাচিত কমিটি পালাক্রমে সংগঠনটি এককভাবে পরিচালনা করেছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে ওই কমিটি তার মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে একের পর এক। বিগত সময়ে আওয়ামীলীগ সরকারের দোসর ব্যক্তিবর্গরাই এই সংগঠন পরিচালনায় জড়িত ছিলেন। সাংগঠনটির গঠনতন্ত্রে কোন পদাধিকারীর তিন টার্মের বেশি দায়িত্ব পালনের বিধান নেই। কিন্তু ব্যক্তি বিশেষ একই পদে তিনবারের অধিক বহাল থেকেছেন। যা সংগঠনের নিয়মনীতির মারাত্মক লঙ্ঘন।

সূত্র জানিয়েছে, গঠনতন্ত্রে প্রতিটি সদস্য মেডিকেল কলেজকে ২৪ হাজার টাকা বার্ষিক চাঁদার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বিগত কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা করে চাঁদা আদায় করেছেন। চাঁদা উত্তোলনের ৯ কোটি ৭০ লাখ টাকার কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছেনা। জানতে চাইলে বিগত কমিটি বিদেশি প্রশিক্ষক এনে ৫ তারকা হোটেলে সদস্যদের প্রশিক্ষণের পিছনে এ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছেন। সংগঠনের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর সংশ্লিষ্টরা সদুত্তর দিতে পারেনি।


বিজ্ঞাপন

দেশে বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৭ টি। এসব কলেজে আসন সংখ্যা ৫ হাজার ৩৮০ টি। বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৬৭ টি। যাতে ৬ হাজার ২৯৩ টি আসন রয়েছে। মেডিকেল শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টরের ভূমিকা অগ্রগন্য। ১৯৮৬ সালে দেশে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ নামে বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার সূচনা হয়। পরবর্তীতে মেডিকেল শিক্ষাকে বেসরকারী খাতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলেও এর নিয়ন্ত্রণ ও একচেটিয়া প্রভাব মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হয়।


বিজ্ঞাপন

বেসরকারি মেডিকেল খাতের ৬ জন ব্যক্তি এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কুক্ষিগত করে রাখেন এবং নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের মাধ্যমে পরিণত করেন। তারা সরকারি প্রভাব নিজেদের অনুক‚লে নিয়ে নিজ মেডিকেল কলেজের আসন বৃদ্ধি ও দুর্নীতির বিস্তৃতি ঘটান বলে অভিযোগ রয়েছে। বিগত কমিটির সভাপতি মুবিন খানের মেডিকেল কলেজের নাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ। শুরুতে এর আসন সংখ্যা ছিল ৫০ টি। পরে সরকারি আনুক‚ল্যে তিনি আসন সংখ্যা ১৩০ এ উন্নীত করে নেন। অনুরূপভাবে সাধারণ সম্পাদক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেনের ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজের আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১২৭, ফ্যাসিস্ট সরকারের মন্ত্রী এনামুল হকের এনাম মেডিকেল কলেজের আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১৫৫, মোস্তাফিজুর রহমানের পপুলার মেডিকেল কলেজের আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১০৫ এবং আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজের আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১৪৭ এ উন্নীত করে নেন। অথচ ক্যাম্পাস, পাঠদান কক্ষ, অত্যাধুনিক ল্যাবরেটারি ও অন্যান্য সকল সুবিধা থাকা সত্তে¡ও বহু মেডিকেল কলেজের আসন সংখ্যা বৃদ্ধির আবেদন আমলে নেওয়া হয়নি। বিগত কমিটি প্রতিষ্ঠানের নামে একটি অফিস ববাদ ফ্ল্যাট ক্রয় করলেও তার রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি। প্রায় কোটি টাকায় কেনা ফ্ল্যাটটি ক্রয়েও অনিয়ম করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।  ৫ আগস্টের পর সরকার পরিবর্তন হলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। যা ছিল নিয়ম বহির্ভূত। কমিটি একটি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের জন্য বিদেশ থেকে লোক এনে অপ্রয়োজনীয় সেমিনারের আয়োজন করেন। যার পেছনে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি টাকা। এ অনুষ্ঠানের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয় মুবিন খানের প্রতিষ্ঠানকে। যিনি নির্বাহী কমিটির সভাপতি ছিলেন। গাজীপুরে মুবিন খানের তত্ত্বাবধানে একটি অপ্রয়োজনীয় কনসার্টের করা হয়। সেখানেও কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেককে তুষ্ট রাখতে এসোসিয়েশনের তহবিল থেকেও কয়েক কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানিয়েছে, সাধারণ সদস্যদের দাবির মুখে সর্বশেষ গত ১৬ জুলাই বিপিএমসিএ’র ইতিহাসে প্রথমবারের মত নির্বাহী কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের দ’ুটি প্যানেল প্রতিদ্ব›দ্বীতা করেন। নির্বাচনের মহিউদ্দিন-মুকিত পরিষদ থেকে ডা. শেখ মহিউদ্দিন সভাপতি এবং আফরোজা-মোয়াজ্জেম পরিষদ থেকে ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মহিউদ্দিন-মুকিত পরিষদ থেকে ডা. আব্দুস সবুর সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাকি ১৯ টি পদে আফরোজা-মোয়াজ্জেম পরিষদের প্রার্থীরা বিজয়ী হন। কিন্তু বিগত দিনের গোষ্ঠী চক্রটি এই নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের জন্য নতুন করে উঠে পড়ে লেগেছে।

বিপিএমসিএ’র সংঘ বিধির ২৭ ধারা মোতাবেক কার্যনির্বাহী কমিটির ২০২৫-২০২৭ মেয়াদের নির্বাচনের জন্য গত ২৫ মার্চ ডাঃ মো: মঈনুল আহসানকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন বোর্ড গঠন করা হয়। তবে গত ১৬ জুন প্রকাশিত বৈধ মনোনীত প্রার্থীর চূড়ান্ত তালিকা নির্বাচন বোর্ডের সভাপতির একক স্বাক্ষরে প্রকাশিত হয়।

জানা গেছে, ১৫ জুন নির্বাচন বোর্ড মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাইয়ের সময় ইতিপূর্বে ঘোষিত নির্বাচনী নিয়মাবলীর ৫ নং ধারা অনুযায়ী বেশ কিছু মনোনয়ন পত্র বাতিল হয়ে যায়। যদিও নির্বাচন বোর্ডের ২ জন সদস্য তাদের করা ও ঘোষিত নিয়মাবলীতে অনঢ় থাকতে চান, কিন্তু নির্বাচন বোর্ডের সভাপতি তাতে সম্মতি দেননি।

এদিকে নির্বাচনের দিন ভোটগ্রহণ চলাকালে সিলেটের সাবেক মেয়র আরিফুল হক কেন্দ্রে অনুপ্রবেশ করাকে নির্বাচনে অবৈধ হস্তক্ষেপ বলে জানান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। বেলা ১২টার দিকে আরিফুল হক কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মীদের উপেক্ষা করে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ চলাকালে আকস্মিক এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

এদিকে ১৬ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলকভাবে অনুষ্ঠিত হয়, যা দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচনে মহিউদ্দিন-মুকিত প্যানেল এবং আফরোজা-মোয়াজ্জেম প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন এবং মোট ১১০ জন ভোটারের মধ্যে ৯২ জন ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।

চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার পর আফরোজা-মোয়াজ্জেম প্যানেলের পক্ষ থেকে নিয়ম বর্হিঃভূতভাবে আপিল দায়ের করা হয়েছে এবং আপিল বোর্ড এখতিয়ার বর্হিঃভূতভাবে তা গ্রহণ করেন। কারণ আপিল গ্রহণের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হওয়ার পর রাত সাড়ে ৮টার দিকে আপিল আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। যা নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটাররা দিনভর ভোট প্রদানের পর দুই পরিষদের মনোনীত এজেন্টরা খসড়া ফলাফলে স্বাক্ষর করেন। আফরোজা-মোয়াজ্জেম প্যানেল থেকে ড. শাহ মো. সেলিম স্বাক্ষর করেন। যিনি এই নির্বাচনে কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

বর্তমানে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে ভোটারদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার চেষ্টা চলছে। ভোটারদের মতামতের প্রতি সম্মান জানিয়ে এবং সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্র রুখতে এই আপিল আবেদন যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাতিল করা হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

👁️ 34 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *