প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ডিজিটাল দুর্নীতি : গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের আঁতাতে হাজার কোটি টাকার লুটপাট ! 

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত কর্পোরেট সংবাদ জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক  :  বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, যাদের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মেজর জেনারেল আমজাদ খান চৌধুরী (অবঃ)। বর্তমান মালিক আহসান খান চৌধুরী  দেশীয় খাদ্য ও প্লাস্টিক শিল্পে বিশাল ভূমিকা রাখলেও সাম্প্রতিক অভিযোগে উঠে এসেছে—এই গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি ক্রয়ে ভয়াবহ দুর্নীতি ও প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।


বিজ্ঞাপন

আর এই প্রতারণার মূলে রয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রভাবশালী নির্বাহী প্রকৌশলীদের সরাসরি সহযোগিতা। ব্যক্তিগত আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে তারা শুধু আইন ভেঙে প্রাণ-আরএফএলকে কাজ পাইয়ে দেননি, বরং নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেও বিল পাসে সহযোগী হয়েছেন। ফলে সরকারি অর্থের হাজার কোটি টাকা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, অথচ দায় কেউ নিচ্ছে না।

ভুয়া আমদানির গল্পে লিফট কেলেঙ্কারি  :  প্রাণ-আরএফএল এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান Rangpur Metal Industries Ltd. গত ২/৩ বছরে গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার লিফট সরবরাহের কার্যাদেশ পেয়েছে। শর্ত ছিল ফিনল্যান্ডের Kone Lift সরবরাহের।


বিজ্ঞাপন

কিন্তু বাস্তবতা চমকে দেওয়ার মতো—এলসি খোলা হয়েছে ভারতের Kone Regional Office-এ।শিপমেন্ট দেখানো হয়েছে জার্মানি থেকে, অথচ জার্মানিতে Kone-এর কোনো কারখানা নেই।  প্রকৃতপক্ষে সরবরাহ হয়েছে ভারতের তৈরি লিফট, কিন্তু বিল উঠেছে ইউরোপ ক্যাটাগরির দামে।


বিজ্ঞাপন

এভাবে নিম্নমানের ভারতীয় পণ্য এনে ইউরোপীয় পণ্যের নামে বিল উত্তোলন করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। অথচ গণপূর্তের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা সব জেনেও চোখ বন্ধ করে ছিলেন, কারণ তাদের ভাগ ঠিকমতো পৌঁছে গেছে।

ফায়ার পাম্পে জীবনসংহারী প্রতারণা  : এখানেই শেষ নয়। Property Development Ltd. নামক প্রতিষ্ঠান গণপূর্তের বিভিন্ন প্রকল্পে UL listed Fire Pump সরবরাহের চুক্তি নেয়। কিন্তু বাস্তবে সরবরাহ করা হয় নকল ও Non-UL listed Pump। এতে কোটি কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় ক্ষতি হয়েছে।

সবচেয়ে ভয়াবহ হলো—এই মানহীন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মানুষের জীবন সরাসরি ঝুঁকির মুখে পড়বে।

এত বড় জননিরাপত্তার ইস্যুতেও গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীরা বিল পাসে সহযোগী হয়েছেন, কারণ তারা মোটা অঙ্কের কমিশনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

একই প্রতিষ্ঠানের দুই নাম, হাজার কোটির খেলা :  চাঞ্চল্যকর অভিযোগ হলো—একই কোম্পানি দুটি ভিন্ন নামে সরকারি টেন্ডারে অংশ নিয়ে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। “Rangpur Metal Industries Limited” নামে ১০১টি কাজ → ২৮৮.৪৮ কোটি টাকা। “Rangpur Metal Industries Ltd.” নামে ১১২টি কাজ → ৭৭১.৩৯ কোটি টাকা। মোট ২১৩টি ওয়ার্ক অর্ডারে অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১,০৬০ কোটি টাকা।

যদিও কোম্পানির মালিকানা, পরিচালনা পর্ষদ ও অফিসের ঠিকানা অভিন্ন, তবুও আলাদা BIN ও TIN ব্যবহার করে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার প্রতিযোগিতাকে পাশ কাটানো হয়েছে। এটি সরকারি ক্রয় বিধি (PPR 2008) এর সরাসরি লঙ্ঘন।

গণপূর্ত কর্মকর্তাদের ভূমিকা: সিন্ডিকেটের অভিভাবক : অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের কয়েকজন নির্বাহী প্রকৌশলী, যারা এই দুর্নীতি ঢাকতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।

মাসুম বিল্লাহ (এসডিই, শের-ই-বাংলা নগর ৩ নং উপবিভাগ): টেন্ডার অনুমোদন ও বিল পাসে প্রাণ-আরএফএলকে সরাসরি সুবিধা দিয়েছেন। মিজানুর রহমান (নির্বাহী প্রকৌশলী, ঢাকা জোন): ভুয়া শিপমেন্ট ডকুমেন্ট যাচাই না করে অনুমোদন করেছেন। রফিকুল ইসলাম (নির্বাহী প্রকৌশলী, চট্টগ্রাম জোন): UL listed নয় এমন ফায়ার পাম্প গ্রহণে সহযোগিতা করেছেন। আলমগীর হোসেন (নির্বাহী প্রকৌশলী, সদর দপ্তর): একই প্রতিষ্ঠানের দুটি নামের টেন্ডার অংশগ্রহণ বৈধতা দিয়েছেন। এরা প্রত্যেকে সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অভিযোগ রয়েছে, প্রত্যেকে কোটি টাকার কমিশন ও ঘুষ গ্রহণ করেছেন।

দুদকে লিখিত অভিযোগ :  ২০২৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সচেতন নাগরিক মো. মিলন মৈত্রা এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়—Audit Firm ও DVS যাচাইয়ে নথি অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। RJSC নিবন্ধন নীতিমালা পাশ কাটিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

ই-জিপি (e-GP) সিস্টেমের স্বচ্ছতা নষ্ট হয়েছে। মালিকপক্ষের ভূমিকা: কর্পোরেট প্রপাগাণ্ডা। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ সবসময় নিজেদের গৌরব প্রচার করে—১ লক্ষাধিক কর্মসংস্থান, ২৫টির বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বিশ্বের ১৪০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি।

কিন্তু বাস্তবে মালিকপক্ষের অনুমোদন ছাড়া এমন দ্বৈত পরিচয়ে সরকারি টেন্ডার ও ভুয়া আমদানি সম্ভব নয়। তাই প্রশ্ন উঠেছে—
প্রাণ-আরএফএল মালিকানার ছত্রছায়াতেই কি এই সিন্ডিকেট রাষ্ট্রীয় অর্থ লুট করছে?

উপসংহার :  প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের এই আঁতাত শুধু অর্থনৈতিক নয়, নিরাপত্তাজনিত ভয়াবহ সংকটও তৈরি করেছে।

ইউরোপীয় পণ্যের নামে ভারতীয় নিম্নমানের লিফট, UL listed নয় এমন ফায়ার পাম্প,  একই প্রতিষ্ঠানের দুটি নাম ব্যবহার করে হাজার কোটি টাকার প্রতারণা,  এবং কর্মকর্তাদের ঘুষ-কমিশন বাণিজ্য—সবকিছু মিলে বাংলাদেশের সরকারি ক্রয়ব্যবস্থাকে ভেঙে দিচ্ছে।

এখন সময় এসেছে দুদক, BPPA ও CPTU-কে সমন্বিতভাবে কঠোর তদন্ত চালানোর। অন্যথায় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের এই কর্পোরেট দুর্নীতি এবং গণপূর্ত কর্মকর্তাদের যোগসাজশ বাংলাদেশের প্রশাসনিক ইতিহাসে আরেকটি কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *