বদলির আগে সরকারি কোয়ার্টারের দরজা-জানালা খুলে নিলেন প্রকৌশলী  : পাবনা গণপূর্তের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইব্রাহিম বিশ্বাসের কর্মকাণ্ডে তোলপাড় প্রশাসন : তদন্ত কমিটি গঠন

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি আইন ও আদালত জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক :  পাবনায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক উপ-সহকারী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে সরকারি কোয়ার্টারের দরজা-জানালা ও অন্যান্য সামগ্রী খুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত কর্মকর্তা হলেন ইব্রাহিম বিশ্বাস, যিনি বদলির আগে সরকারি বাসা খালি করার সময় এই ঘটনা ঘটান বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের অভ্যন্তরে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, “একজন প্রকৌশলী যদি সরকারি সম্পত্তি খুলে নিয়ে যান, তবে সাধারণ নাগরিকের জন্য কী বার্তা রইল?”


বিজ্ঞাপন

ভবনে ভুতুড়ে নীরবতা  :  ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা যায়, পাবনা শহরের সরকারি গণপূর্ত কোয়ার্টার এলাকার একটি ভবন এখন প্রায় পরিত্যক্ত। দরজা-জানালা, আসবাবপত্র ও কাঠের ফ্রেম খুলে নেওয়ায় ভবনটি যেন এক ভুতুড়ে পরিবেশে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়দের ধারণা, বদলির আগে ইব্রাহিম বিশ্বাস নিজেই এগুলো খুলে নিয়ে যান। প্রায় ছয় মাস আগে তাকে পাবনা থেকে রাঙামাটিতে বদলি করা হয়। বদলির পরও তিনি সরকারি কোয়ার্টার ত্যাগ না করে সেখানে অবস্থান করতেন। পরে বাসা ছাড়ার সময় ভবনের দরজা-জানালা ও ফার্নিচার খুলে নিয়ে যান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পাবনা গণপূর্ত সার্কেলের ৪ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন  : এ বিষয়ে  গত ১৫ অক্টোবর পাবনা গণপূর্ত সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেওয়ান মাউদুদুর রহমান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে জানা গেছে পাবনা গণপূর্ত বিভাগের আওতাধীন গণপূর্ত উপ-বিভাগ -১ বদলীকৃত উপসহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) জনাব মো : ইব্রাহিম বিশ্বাস কর্তৃক বসবাসকৃত সরকারি বাসভবনের মালামাল খুলে নিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত একটি ভিডিও ও একটি প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এর প্রেক্ষিতে প্রকৃত ঘটনা জাচাই এবং দায়ী বেক্তিকে সনাক্ত পূর্বক সরকারি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপনের জন্য নিম্নলিখিত কর্মকর্তাগণের  সহযোগীতায় পাবনা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কে আহ্বায়ক করে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।


বিজ্ঞাপন

উক্ত তদন্ত কমিটির সদস্যরা যথাক্রমে, নির্বাহী প্রকৌশলী গণপূর্ত বিভাগ পাবনা (আহ্বায়ক) উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (সিভিল) পাবনা গণপূর্ত উপ বিভাগ -১ পাবনা (সদস্য) উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী, গণপূর্ত (ই/এম) উপ বিভাগ পাবনা (সদস্য) এবং সহকারী প্রকৌশলী, পাবনা গণপূর্ত সার্কেল, পাবনা (সদস্য সচিব)।


বিজ্ঞাপন

তদন্ত কমিটি কে আগামী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। উক্ত অফিস আদেশের স্মারক নং-২৫.৩৬.৭৬০০.৩০০.১৬.০৮০.২৪/৩০১।

স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া  : ‘সরকারি সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা’ :  সচেতন নাগরিক এবিএম ফজলুর রহমান বলেন,  “সরকারি সম্পত্তি জনগণের সম্পদ। একজন প্রকৌশলী যদি নিজেই সরকারি মালামাল খুলে নিয়ে যান, তাহলে প্রশাসনিক নৈতিকতা কোথায় থাকে?”

একই সুরে কথা বলেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি কমরেড জাকির হোসেন, “এটা শুধু দায়িত্বের অপব্যবহার নয়, বরং দুর্নীতির অংশ। এমন ঘটনার সঙ্গে আরও বড় অনিয়ম যুক্ত থাকতে পারে।”

বক্তব্য দিতে নারাজ তদন্ত কমিটি  :  এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে নির্বাহী প্রকৌশলী গণপূর্ত বিভাগ,  উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (সিভিল) পাবনা গণপূর্ত উপ বিভাগ -১ পাবনা (সদস্য) উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী, গণপূর্ত (ই/এম) উপ বিভাগ পাবনা (সদস্য) এবং সহকারী প্রকৌশলী, পাবনা গণপূর্ত সার্কেল, পাবনা (সদস্য সচিব) এর মোবাইলে একাধিক বার  যোগাযোগ করা হলে তারা মোবাইল রিসিভ না করায় তাদের কোন প্রকার বক্তব্য প্রকাশিত হলো না।

কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ  : স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ইব্রাহিম বিশ্বাস পাবনা গণপূর্তে কর্মরত থাকা অবস্থায় ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। তিনি প্রভাব খাটিয়ে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতেন এবং কাজের বিনিময়ে ঘুষ গ্রহণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নিজের মুখেই স্বীকারোক্তি  :  একটি কল রেকর্ডে শোনা যায়, অভিযুক্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইব্রাহিম বিশ্বাস দরজা-জানালা খুলে নেওয়ার কথা নিজেই স্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেন, “সেগুলো সংরক্ষণের জন্য নেওয়া হয়েছিল, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে পুনরায় স্থাপন করা হবে।”

তবে তার এই ব্যাখ্যা অনেকের কাছে দায়সারা অজুহাত বলে মনে হয়েছে।

কর্মকর্তাদের নীরবতা ও গোপন তৎপরতা  :  সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মিজানুর রহমান তড়িঘড়ি করে অফিস ত্যাগ করেন। নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদ কবির গোপনে ধারণ করা এক সাক্ষাৎকারে জানান, “ঘটনাটি সম্পর্কে আমি এখনো অবগত নই। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

অন্যদিকে, অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি হননি। এ ঘটনায় বিভাগের অভ্যন্তরীণ অনিয়ম ও যোগসাজশের প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে।

‘অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ঢাকতে নীরব প্রশাসন’  :  সচেতন মহল মনে করে, একটি সরকারি কোয়ার্টারের দরজা-জানালা খুলে নেওয়ার মতো ঘটনা নিছক সামান্য নয়। এটি প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার এক নগ্ন উদাহরণ। যারা দায়িত্বে থেকে নীরব রয়েছেন, তারাও নৈতিকভাবে দায় এড়াতে পারেন না।

তদন্ত দাবি ও পরবর্তী পদক্ষেপ :  পাবনা জেলাবাসী ও স্থানীয় নাগরিক সমাজ দ্রুত তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
তারা বলছেন—গণপূর্তের মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের আচরণ প্রশাসনিক স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ইব্রাহিম বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ শুধু দরজা-জানালা চুরিতেই সীমাবদ্ধ নয়; তার অতীত কর্মকাণ্ড, কমিশন বাণিজ্য ও প্রভাব খাটানোর ইতিহাস এখন আলোচনার কেন্দ্রে।

বদলির আগে সরকারি কোয়ার্টার খুলে নেওয়া, কমিশন বাণিজ্য আর প্রভাব খাটানোর এই ঘটনা প্রমাণ করে—গণপূর্ত অধিদপ্তরের অভ্যন্তরে এখনো দুর্নীতির নৈরাজ্য প্রবল। একজন উপ-সহকারী প্রকৌশলীর এমন দুঃসাহস যদি প্রকাশ্যে ঘটে, তাহলে ভেতরের বড় অনিয়মের গভীরতা অনুমান করাই যায়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এখন জরুরি—স্বচ্ছ তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *