!!  সিন্ডিকেটের কবলে ক্রীড়া পরিদপ্তর !! সরকারি অর্থ লুটে নিয়েছে ‘ত্রিমুখী চক্র’ !!  অফিস প্রধানের অনুমতি ছাড়াই কোটি টাকার বিল উত্তোলন !!  ভুয়া প্রশিক্ষণ, আত্মসাত ও ফাইল গায়েবের মহোৎসব

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত খেলাধুলা জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক  :  ঢাকা বাংলাদেশের ক্রীড়া বিকাশের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ক্রীড়া পরিদপ্তর আজ এক ভয়াবহ সিন্ডিকেটের কবলে। এই চক্রের মূল হোতা হিসেবে নাম এসেছে তিন কর্মকর্তার— এস আই এম ফেরদৌস আলম (সহকারী পরিচালক, প্রশাসন), আলীমুজ্জামান (সহকারী পরিচালক, সংগঠন) এবং মো. আজিম হোসেন (সহকারী পরিচালক, প্রশাসন)। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—অফিস প্রধানের অনুমোদন ছাড়াই কোটি কোটি টাকা সরকারি অর্থ ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে আত্মসাৎ, একই বিল একাধিকবার তোলা, এবং অনিয়ম ধামাচাপা দিতে ফাইল গায়েব করে ফেলা।


বিজ্ঞাপন

‘অফিস প্রধান গৌণ’: সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করে টাকা তোলা  :  অভিযোগ রয়েছে, গত তিন অর্থবছর ধরে ক্রীড়া পরিদপ্তরের অফিস প্রধান বা পরিচালকের স্বাক্ষর ছাড়াই বিল উত্তোলনের প্রধান ভূমিকা পালন করেছে এই ত্রিমুখী চক্র। নথি অনুসারে, ২০২২–২৩ অর্থবছরে মাত্র ৯টি কোটেশনের মাধ্যমে ২৭ লাখ টাকা এবং অতিরিক্ত ৬ লাখ টাকা দুই কোটেশনে তুলে নেয় তারা। এরপর ‘সঞ্জিবনী প্রশিক্ষণ’ ও ‘বিচ ফুটবল আয়োজন’-এর নামে আরও ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়। সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগ—বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট ২০২১ আয়োজনের নামে ১০ কোটি টাকার ব্যয় দেখানো হলেও তার কোনো ভাউচার বা হিসাব দাখিল করা হয়নি। এমনকি অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার দুই মাস আগেই “আপ্যায়ন বাবদ” কয়েক লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়।

ভুয়া প্রশিক্ষণ ও জাল মাস্টাররোল: কাগজে খেলোয়াড়, মাঠে শূন্যতা  :  পরিদপ্তরের বার্ষিক ক্রীড়া কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রতি বছর ৬৪ জেলায় ফুটবল, সাঁতার ও অ্যাথলেটিকস প্রশিক্ষণের জন্য ৪০–৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তদন্তে দেখা গেছে—এসব প্রশিক্ষণ কাগজে সম্পন্ন দেখানো হয়, মাঠে কোনো কার্যক্রম হয় না। ২০২৩ সালের বরাদ্দ আসে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, অথচ অক্টোবরেই কিছু জেলার প্রশিক্ষণ শেষ দেখানো হয়েছে! ফেনী, গোপালগঞ্জ ও চট্টগ্রাম জেলায় প্রশিক্ষণার্থীদের নাম ভুয়া মাস্টাররোলে এক ব্যক্তি লিখেছেন, স্বাক্ষরও এক হাতের। একই মাস্টাররোলে কখনো “সাঁতার”, কখনো “অ্যাথলেটিকস”, আবার কোথাও “ভলিবল প্রশিক্ষণ” লেখা হয়েছে।


বিজ্ঞাপন

ফাইল গায়েব করে ১১ কোটি টাকার বিল আত্মসাৎ  :  ২০২২–২৩ অর্থবছরে “বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ক্রয়কৃত ক্রীড়া সামগ্রী” বাবদ ১১ কোটি ৪৮ লাখ ৮ হাজার ১৩৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগও প্রমাণিত। অফিস প্রধানের অনুমোদন ছাড়াই ৫টি বিল (বিল নং ১৬০–১৬৪) পাস করিয়ে এই অর্থ উত্তোলন করা হয়। পরিচালক অনুমোদন না দিলে ফাইলটি গায়েব করে দেওয়া হয়। অবশেষে গত ১৩ সেপ্টেম্বর একজন কর্মকর্তার হেফাজত থেকে ফাইলটি উদ্ধার হয়। ঘটনা প্রকাশ পেলে সিন্ডিকেটের সদস্যরা ওই কর্মকর্তা বদলির দাবিতে মানববন্ধন করেন—যা প্রশাসনিক সন্ত্রাসের এক নজিরবিহীন উদাহরণ।


বিজ্ঞাপন

জাল সরবরাহ ও মজুদ রেজিস্টারে ভূতুড়ে এন্ট্রি  :  তদন্তে দেখা গেছে, স্টোর ইনচার্জ ফিরোজ হাসান ঠিকাদার মালামাল সরবরাহের দুই মাস আগেই “বুঝে পাওয়া”র ভুয়া এন্ট্রি করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, লট–৪-এর ভলিবল ও হ্যান্ডবল সরবরাহ করা হয় ১৭ জুলাই ২০২৩—কিন্তু রেজিস্টারে দেখা যায়, “বুঝে পাওয়া” দেখানো হয়েছে ১৭ মে ২০২৩! অর্থাৎ মালামাল সরবরাহের দুই মাস আগেই বিল পাস করে টাকা তুলে নেওয়া হয়।

বদলির খড়্গ’ ও পরিচালক তরিকুল ইসলামের অভিজ্ঞতা  : 
ক্রীড়া পরিদপ্তরের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) আ ন ম তরিকুল ইসলাম বিল অনুমোদনে অনিয়মের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলায় বদলির মুখে পড়েন। তিনি বলেন, “এই দপ্তরে অনিয়মটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। সরকারি অর্থ তোলার জন্য অফিস প্রধানের অনুমোদন লাগে না—এমন দপ্তর আর কোথাও নেই।”

তার ভাষায়, “যখন বলেছি বিধিবহির্ভূত কাজ বন্ধ করতে হবে, তখনই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়। দুর্নীতির প্রতিবাদ করাটাই আমার অপরাধ।”

ঢাকা জেলার ক্রীড়া অফিসার জাহাঙ্গীরের ‘গোপন সহায়তা’  :  চক্রটিকে সহায়তা করেছেন ঢাকা জেলা ক্রীড়া অফিসার মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, যিনি বেনামে ভাই ভাই খেলাঘর, বি.টেক্স ও বিজনেস ওয়ার্ল্ড নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান খুলে ভুয়া ভাউচার সরবরাহ করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেই ৬৪ জেলার অফিসে সাদা ভাউচার পাঠানো হয়, যেখানে ইচ্ছেমতো অঙ্ক বসিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

দুদকের অভিযান ও প্রাথমিক সত্যতা  :  দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে ক্রীড়া পরিদপ্তরে অভিযান চালিয়েছে। সহকারী পরিচালক রুবেল হাসান ও উপসহকারী পরিচালক সুবিমল চাকমার নেতৃত্বে গঠিত টিম বেশ কয়েকটি নথি জব্দ করেছে। তারা প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে এবং নথিতে অর্থ আত্মসাতের একাধিক প্রমাণ পেয়েছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেই বদলি’  :  অভিযোগ আছে—যে কেউ এই সিন্ডিকেটের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেই তাকে বদলির মুখে পড়তে হয়। পরিচালক তরিকুল ইসলামের মতো আরও কয়েকজন কর্মকর্তা এ চক্রের ‘বদলির রাজনীতি’র শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে, সহকারী পরিচালক ফেরদৌস আলম, আলীমুজ্জামান ও আজিম হোসেন নিজেদের বিরুদ্ধে অভিযোগকে “অমূলক” দাবি করে বলেছেন, “আমরা নিয়ম মেনেই কাজ করি, বিল অনুমোদনের আগে অফিস প্রধানের স্বাক্ষর লাগে।” কিন্তু সরকারি নথি বলছে ভিন্ন কথা।

উপসংহার  : খেলাধুলার নামে লুটের সাম্রাজ্য ১৯৭৬ সালে তরুণ প্রজন্মের প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ক্রীড়া পরিদপ্তর আজ সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। ভুয়া প্রশিক্ষণ, আগাম ব্যয়ের হিসাব, বিল গায়েব, জাল স্বাক্ষর আর ভয়ভীতি—সব মিলে এই দপ্তর এখন দুর্নীতির হাব। দুদকের তদন্তে যদি দ্রুত আইনি পদক্ষেপ না আসে, তাহলে “খেলাধুলা বিকাশের কেন্দ্র” পরিণত হবে দুর্নীতির স্থায়ী আস্তানায়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *