নির্মাণ প্রকল্প থেকে সরে আসছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় : অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ও নীতিগত দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ 

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক  :  দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন আসছে। সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে মন্ত্রণালয়টি এখন থেকে আর কোনো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণমূলক প্রকল্প হাতে নিতে পারবে না। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে চলা প্রকৌশলভিত্তিক কাজের দায়িত্ব থেকে মন্ত্রণালয়কে সরিয়ে দেওয়া হলো—যা প্রশাসনিক কাঠামো ও আর্থিক জবাবদিহিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তন নির্দেশ করছে।


বিজ্ঞাপন

নীতিগত পরিবর্তনের পটভূমি ও উদ্দেশ্য : ৬ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সরকারের যুক্তি হলো—দেশে ইতিমধ্যেই LGED, PWD, এবং Water Development Board-এর মতো বিশেষায়িত প্রকৌশল সংস্থা রয়েছে, যারা অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি অভিজ্ঞ ও সক্ষম। তাই ‘Allocation of Business’ অনুযায়ী ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব রাখা যুক্তিযুক্ত নয়।

এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকারের উদ্দেশ্য হলো, মন্ত্রণালয়কে তার মূল ম্যান্ডেট—দুর্যোগ মোকাবেলা, পুনর্বাসন, ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের সহায়তা ও দ্রুত সাড়া প্রদানের কাজে মনোনিবেশ করানো। দীর্ঘদিন ধরে প্রকৌশলগত প্রকল্পে জড়িয়ে মন্ত্রণালয়টি তার প্রাথমিক দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল—এই পুনর্বিন্যাস সেই বিচ্যুতি রোধের অংশ।


বিজ্ঞাপন

অতীত কার্যক্রম ও চলমান প্রকল্পসমূহ  : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এতদিন যে সকল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছিল, তার মধ্যে ছিল—বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ (বন্যাপ্রবণ ও নদীভাঙন এলাকায়)  ,গ্রামীণ রাস্তায় ১৫ মিটার পর্যন্ত সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ, গ্রামীণ রাস্তায় এইচবিবি (HBB) কাজ, জেলা ত্রাণ গুদাম কাম দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র, জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জাতীয় সদর দপ্তর নির্মাণ।


বিজ্ঞাপন

বর্তমানে চলমান বড় প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে— বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ (৩য় পর্যায়): চলতি অর্থবছরে ৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণাধীন, পরের অর্থবছরে ৬৩টি সম্পন্ন হবে।গ্রামীণ সেতু ও কালভার্ট প্রকল্প: ১,১০০টির বেশি ব্রিজের কাজ চলমান।

দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্প  : ১৪৩টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণাধীন। এখন প্রশ্ন হলো—এই প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে? সরকার জানিয়েছে, চলমান প্রকল্পগুলোর বিষয়ে পৃথক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে; তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের নতুন প্রকল্প আর এই মন্ত্রণালয়ের আওতায় থাকবে না।

অদক্ষতা, অনিয়ম ও ব্যয়ের যুক্তি  :  সরকারি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ১৭ বছরে এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রায় ২১০০ কোটি টাকা ব্যয় না করেই সময় ও সম্পদের অপচয় ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প বিলম্বিত, পুনঃনির্ধারিত বা আংশিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এতে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ও নীতিগত দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অবকাঠামোগত প্রকল্পে অনিয়ম, পুনরাবৃত্তি ও জবাবদিহির অভাব ছিল অন্যতম সমস্যা। এই প্রেক্ষাপটে মন্ত্রণালয়কে নির্মাণখাত থেকে সরিয়ে আনা হলে সরকারি অর্থব্যবস্থাপনা আরও সুশৃঙ্খল হবে।

মূল ম্যান্ডেটে প্রত্যাবর্তন: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নতুন দিকনির্দেশনা
এই পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে মন্ত্রণালয় তার মূল দায়িত্বে—দুর্যোগ প্রতিরোধ, আগাম সতর্কতা, উদ্ধার তৎপরতা ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন—নিয়ে আরও মনোযোগী হতে পারবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, নীতি নির্ধারণ ও মানবিক সহায়তা প্রদানে মনোযোগী মন্ত্রণালয়গুলোর কাজ নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়া উচিত নয়। কারণ এতে মূল নীতিগত ও মানবিক কাজগুলো ব্যাহত হয়।

এই প্রেক্ষাপটে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পুনর্গঠনকে অনেকেই ‘নীতিনির্ভর প্রশাসনিক সংস্কার’ হিসেবে দেখছেন, যা ভবিষ্যতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামোকে আরও স্বচ্ছ ও দক্ষ করবে। সম্ভাব্য প্রভাব ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রশাসনিক কিছু চ্যালেঞ্জও তৈরি হবে। বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রকৌশলী ও মাঠকর্মীদের একটি বড় অংশ নির্মাণ প্রকল্পে যুক্ত। তাদের দায়িত্ব পুনর্বিন্যাস, জনবল স্থানান্তর ও বাজেট পুনর্গঠন একটি জটিল প্রশাসনিক প্রক্রিয়া।

অন্যদিকে, স্থানীয় পর্যায়ে অনেক আশ্রয়কেন্দ্র ও ব্রিজ প্রকল্প এখন মাঝপথে। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন অধিদপ্তর পরিবর্তনের কারণে সময়সীমা ও ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে, সরকারকে একটি “ট্রানজিশন ফেজ” পরিকল্পনা করতে হবে যাতে কাজ বন্ধ না হয়ে প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।

উপসংহার :  দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এই পুনর্বিন্যাস কেবল একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়—এটি সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং মূল দায়িত্বে প্রত্যাবর্তনের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত।
নির্মাণ প্রকল্প থেকে সরে এসে মন্ত্রণালয় যদি দুর্যোগ মোকাবেলায় দক্ষতা ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রদানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে, তবে এটি হবে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের একটি সফল উদাহরণ—যা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুশাসন নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *