দুর্নীতির বরপুত্র এলজিইডির মঞ্জুর আলী : ৫% হারে ঘুষ নিয়ে ১১২২ কোটি টাকা বরাদ্দ, আত্মীয়-স্বজন নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের মহোৎসব !

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক :  স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)-এর সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মোঃ মঞ্জুর আলীর বিরুদ্ধে উঠেছে চাঞ্চল্যকর দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তিনি পিআরএল (অবসর) যাওয়ার প্রাক্কালে ব্যাকডেটেড ফাইল স্বাক্ষর, ৫% হারে ঘুষের বিনিময়ে ১১২২ কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন, আত্মীয়স্বজনদের নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।


বিজ্ঞাপন

ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর এলজিইডি ভবনে সৃষ্টি হয়েছে তোলপাড়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে মুখে এখন “দুর্নীতির বরপুত্র” মঞ্জুর আলীর নামই সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে।

পি আর এল যেয়েও ফাইল স্বাক্ষর !  :  সূত্র জানায়, ১১ অক্টোবর পিআরএল যাওয়ার দিনই মঞ্জুর আলী অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পান। পদোন্নতির তদবিরে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপে থাকায় বিদায় সংবর্ধনায় অংশ নিতে পারেননি তিনি। অথচ ঠিক পরদিনই রাত ৯টা পর্যন্ত এলজিইডির প্রধান ভবনের চতুর্থ তলায় সেমিনার হলে বসে ব্যাকডেটেড অসংখ্য ফাইল স্বাক্ষর করেন তিনি।


বিজ্ঞাপন

সেই ফাইলগুলোর বেশিরভাগই বরাদ্দ সংক্রান্ত — যেখানে ঘুষের বিনিময়ে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প।


বিজ্ঞাপন

৫% হারে ঘুষে ১১২২ কোটি টাকার বরাদ্দ  : বিশ্বস্ত সূত্রের দাবি, RUTDP প্রকল্পের অধীনে ৬৯টি পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে মোট ১১২২ কোটি টাকার বরাদ্দ দেন মঞ্জুর আলী। তবে এই বরাদ্দের সঙ্গে ছিল ঘুষের হিসাব — ৫ শতাংশ হারে। অর্থাৎ বরাদ্দের অনুমোদন পেতে প্রত্যেক পৌরসভাকেই দিতে হয়েছে মোটা অঙ্কের ঘুষ।

এমনকি যেসব পৌরসভা ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তারা বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় থাকা ৮১টি পৌরসভা ও ৬টি সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে ১৮টি প্রতিষ্ঠান শেষ পর্যন্ত কোনো বরাদ্দই পায়নি।

নিজ জেলা ও রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠদের পৌরসভায় ‘সোনার বরাদ্দ’ : দুর্নীতির কৌশল লুকানোর চেষ্টায় মঞ্জুর আলী বরাদ্দ বণ্টনে “অসাধারণ দেশপ্রেম” দেখিয়েছেন বলে ব্যঙ্গ করছে সহকর্মীরা। তার নিজ জেলা দিনাজপুরের পৌরসভাগুলোয় বরাদ্দের পরিমাণ ছিল চোখে পড়ার মতো।

দিনাজপুর সদর পৌরসভা: প্রায় ৫৮ কোটি টাকা , বিরল পৌরসভা: ১১.৫ কোটি টাকা, বিরগঞ্জ পৌরসভা: ৭.৫ কোটি টাকা এবং  বিরামপুর পৌরসভা: প্রায় ১২.৫ কোটি টাকা।

রাজনৈতিক বিবেচনায়ও বরাদ্দ বণ্টনে দেখা গেছে পক্ষপাতিত্ব। বিএনপি-ঘনিষ্ঠ পৌরসভা বগুড়া সদরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় ৫২ কোটি টাকা, যা ওই প্রকল্পের অন্যতম সর্বোচ্চ।

চট্টগ্রাম অঞ্চলেও দেখা গেছে অস্বাভাবিক বরাদ্দ : মিরেরসরাই পৌরসভা: ১৯.৭৫ কোটি টাকা,  পটিয়া: ১৬.৫ কোটি টাকা, নোয়াখালী সদর: ২১.৫ কোটি টাকা, কক্সবাজার পৌরসভা: প্রায় ৩০ কোটি টাকা এবং  ফেনী পৌরসভা: ২৯ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের এক ঠিকাদারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে সেখানে বরাদ্দের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি রাখা হয়।

৫ আগস্টের পর বদলি বাণিজ্যের রাজত্ব : ৫ আগস্ট ২০২৪ — এলজিইডি ভবনের ইতিহাসে “৩৬ আগস্ট” নামে কুখ্যাত। ওই দিন সরকারবিরোধী অস্থিরতার সুযোগে মঞ্জুর আলী অফিসে নিয়ন্ত্রণ নেন। প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আলী আক্তার হোসেনসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা কয়েকদিন অফিসে না এলে, তিনি পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে বদলি বাণিজ্যের সিন্ডিকেট গঠন করেন।

তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও অনুগতদের নিয়ে গঠিত ওই সিন্ডিকেট দেশজুড়ে উপজেলা প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, হিসাব রক্ষকসহ শত শত পদে বদলি করেন ৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে।

একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “মঞ্জুর স্যার বলতেন, বদলি মানে হলো বিজনেস। সবাই খুশি, আমিও খুশি।”

আত্মীয়স্বজনদের চাকরি ও কনসালটেন্ট নিয়োগ : দুর্নীতির আরেক অধ্যায় হলো নিয়োগ বাণিজ্য। দিনাজপুর ও আশপাশের পৌরসভায় কনসালটেন্ট ও আউটসোর্সিং খাতে তার আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন মঞ্জুর আলী। প্রকল্পভিত্তিক নিয়োগে সরকারি প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে তিনি নিজস্ব লোকদের স্থান দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

দুদকের নজরে মঞ্জুর আলী :  বদলি বাণিজ্য ও অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতিমধ্যে শুনানি করেছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ, ঘুষ বাণিজ্য ও নিয়োগ কেলেঙ্কারি নিয়ে অভিযোগ গঠন হয়েছে।

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে মোঃ মঞ্জুর আলীর বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

সমাপনী কথা :  দীর্ঘদিন এলজিইডির গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে ক্ষমতার দাপট দেখানো এই কর্মকর্তা পিআরএল যাওয়ার শেষ মুহূর্তেও দুর্নীতির রেকর্ড গড়ে গেলেন বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। এখন দেখা যাক, দুর্নীতির এই “বরপুত্র”-এর বিরুদ্ধে দুদক ও প্রশাসন আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয় কিনা— নাকি আরেকটি ফাইল ধুলোয় মিশে যাবে ব্যাকডেটেড স্বাক্ষরের মতো।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *