ঢাকা ও ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে আওয়ামী শাসনামলে মুজিব কোট গায়ে দিয়ে প্রভাব, ক্ষমতা ও ব্যক্তিগত সুবিধা ভোগ করা কুখ্যাত খন্দকার মুশতাক আহমেদকে ঘিরে এখন চারদিকে বিতর্কের ঝড়।

একসময়ের প্রভাবশালী এই ব্যক্তি হঠাৎই রাজনৈতিক পোশাক বদলে বিএনপির আশ্রয়ে নাম লেখানোর পর পুরনো নানা অভিযোগ আবারও সামনে আসতে শুরু করেছে—শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতার অপব্যবহার, নারী নির্যাতন, প্রতারণা, এমনকি অল্পবয়সী ছাত্রীকে বিয়ে করার মতো ঘটনাও যুক্ত হয়েছে তাঁর বিতর্কিত জীবনের তালিকায়।
১৬ বছরের ক্ষমতার ছায়ায় “দুই মুখো মুশতাক” ; রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, খন্দকার মুশতাক আহমেদ ছিলেন আওয়ামী শাসনামলের এক বিশ্বস্ত কর্মী। দীর্ঘদিন তিনি রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন প্রশাসনিক ও সংগঠনিক কার্যক্রমে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার বাসিন্দা মুশতাক ঢাকায় ছিলেন আওয়ামী লীগের “বিশেষ অপারেশন টিমের” অংশ, যাদের মাধ্যমে বিএনপি নেতাকর্মীদের দমনপীড়নের নানামুখী কাজ পরিচালিত হতো।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, “জুলাই আন্দোলনের” সময় ও পরবর্তীতে তিনি সক্রিয়ভাবে ফ্যাসিবাদী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
কিন্তু ৫ই আগস্টের পর হঠাৎই রাজনৈতিক পালাবদলের পর তিনি গা থেকে মুজিব কোট খুলে বিএনপির সহ-সভাপতি হিসেবে নাম লেখান, যেন পুরনো দায়মুক্তির নতুন আশ্রয় পান।
স্থানীয়রা বলছেন, “ঢাকায় আওয়ামী, গ্রামে বিএনপি”—এই দ্বিচারিতার মাধ্যমে তিনি সব সময় ক্ষমতার নিরাপদ দূরত্বে থেকেছেন।
মতিঝিল আইডিয়াল কলেজে প্রভাব বিস্তার : মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মুশতাকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতন, প্রভাব খাটানো এবং নৈতিক আচরণবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে তিনি রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
একজন শিক্ষক বলেন, “গভর্নিং বডিতে তাঁর উপস্থিতি মানেই ভয় ও অনৈতিক প্রভাব। অনেক অভিভাবক অভিযোগ করলেও কেউ প্রকাশ্যে মুখ খোলার সাহস পাননি।”
“তিশা-মুশতাক কাণ্ড”: অসম প্রেম না ব্ল্যাকমেইল ? : ২০২৩ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় সিনথিয়া ইসলাম তিশা ও খন্দকার মুশতাক আহমেদের বিয়ের খবর। মাত্র ১৮ বছর বয়সী ছাত্রী ও ৬০ বছরের এক গভর্নিং সদস্যের বিয়ে—এমন অসম বয়সের সম্পর্ক নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
তিশার বাবা সাইফুল ইসলাম ও মা অভিযোগ করেন, “আমাদের মেয়েকে ভয় দেখিয়ে, ব্ল্যাকমেইল করে কাবিননামায় সই করানো হয়েছে। না করলে তার ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে মুশতাক।”
তিশার মা ফেসবুক লাইভে এসে বলেন, “তিশাকে জিম্মি করে বিয়ে করেছে। এখন তাকে হাতিয়ার বানিয়ে নিজের অপরাধ ঢাকছে। তিশা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু মুশতাক তা হতে দিচ্ছে না।”
অন্যদিকে মুশতাকের দাবি, “তিশা ভালোবেসে স্বেচ্ছায় আমাকে বিয়ে করেছে। কেউ কাউকে জোর করেনি।”
২০২৩ সালের জুনে তিশার বাবা ঠাকুরগাঁও আদালতে অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন। তিশা আদালতে হাজির হয়ে জানান, তিনি স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছেন। আদালত তাঁকে স্বামীর জিম্মায় দেন।
ঘটনাটি বর্তমানে বিচারাধীন, তবে পরিবারের অভিযোগে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন তিশার মা, যিনি এখন সরাসরি খন্দকার মুশতাকের শাস্তি দাবি করছেন।
মেধাবী ছাত্রী থেকে জনবিতর্কের কেন্দ্রে : ঠাকুরগাঁওয়ের বকসেরহাট উত্তর গ্রামের এই মেয়েটি একসময় পরিবারের গর্ব ছিল। ছোটবেলা থেকেই নাচ, গান, বিতর্ক ও চিত্রাঙ্কনে দক্ষ তিশা একাধিক পুরস্কার জিতেছেন, এমনকি একবার প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকেও সম্মাননা পান।
তিশার দাদি বলেন, “বুড়াডা মোর নাতিন জামাই হইছে, সমাজে মুখ দেখানো দায়।”
পরিবার বলছে—“স্বপ্নের মেয়েকে এক ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি অর্থ ও প্রভাব দিয়ে প্রলুব্ধ করে জীবন নষ্ট করেছে।”
বইমেলায় জনরোষ : ২০২৪ সালের একুশে বইমেলায় ‘তিশার ভালোবাসা’ নামের বই প্রকাশ করেন মুশতাক-তিশা। দর্শনার্থীদের একাংশ “ভুয়া-ভুয়া” স্লোগান তুলে তাঁদের বের করে দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের কর্মকাণ্ডকে “অরুচিকর ও নৈতিকতাহীন” বলে তীব্র সমালোচনা হয়।
লেখক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ লিখেছেন—“প্রভাব ব্যবহার করে শিক্ষার্থীকে ফুসলিয়ে বিয়ে করা সমাজে ভয়ানক নজির।”
অভিনেতা রাসেল মিয়া মন্তব্য করেন—“এই দম্পতির ভিডিও দেখে অভিভাবকরা আতঙ্কিত। এটি তরুণ প্রজন্মের নৈতিক স্খলনের বড় উদাহরণ।”
শিক্ষা ও রাজনীতিতে নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি : বিশ্লেষকরা বলছেন, এই কাহিনি কেবল এক ব্যক্তির নৈতিক অধঃপতনের গল্প নয়; এটি দুই যুগের ক্ষমতা, প্রভাব ও নীতিহীনতার প্রতিফলন।
একদিকে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির সুবিধাভোগী হিসেবে মুশতাকের ভূমিকা, অন্যদিকে একজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অভিভাবকের নৈতিক অবক্ষয়—দুটিই সমাজে ভয়াবহ উদাহরণ তৈরি করেছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের এক শিক্ষক বলেন, “যে ব্যক্তি শিক্ষার্থীর অভিভাবক হয়ে শিক্ষার্থীকে নিজের স্ত্রী বানায়, সেখানে নৈতিকতা মৃত।”
অভিযুক্তের অবস্থান : খন্দকার মুশতাক আহমেদ সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “এগুলো মিথ্যা ও রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত। আমি আইন মেনে বিয়ে করেছি। এখনো আমার বিরুদ্ধে কেউ প্রমাণ দিতে পারেনি।” তবে তাঁর নীরবতা ও বিতর্কিত অতীত প্রশ্ন তুলছে—রাজনীতি, প্রভাব আর অর্থের মিলনে কি ন্যায়বোধ হারিয়ে গেছে?
সম্পাদকীয় মন্তব্য : এই প্রতিবেদনটি আদালতে বিচারাধীন মামলাসহ পারিবারিক অভিযোগ, স্থানীয় সূত্র, প্রকাশিত সংবাদ ও সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে। উল্লিখিত অভিযোগগুলো এখনো প্রমাণিত নয়। আদালতের চূড়ান্ত রায় ও প্রশাসনিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবে।