
নিজস্ব প্রতিবেদক : জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত দুটি আলোচিত মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এবং দেশ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরিফ হাসানকে।

রাজধানীর গুলশান ও কোতোয়ালি থানার দুটি পৃথক মামলায় পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করলে সোমবার (৩ নভেম্বর) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জুয়েল রানার আদালত আবেদন দুটি মঞ্জুর করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী জানান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা গত ২৮ ও ৩০ অক্টোবর তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেন। আজ শুনানির পর আদালত তাদের উপস্থিতিতে গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেন এবং পরবর্তীতে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

গুলশান হত্যা মামলা : গত বছরের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া গণ–অভ্যুত্থানের সময় গুলশান থানায় দায়ের করা মামলায় কামাল হোসেন প্রকাশ সবুজকে হত্যার অভিযোগে নজরুল ইসলাম মজুমদারকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

কোতোয়ালি থানার হত্যাচেষ্টা মামলা : গত বছরের ৫ আগস্ট কোতোয়ালি থানার সিএমএম কোর্ট এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনায় দেশ টিভির এমডি আরিফ হাসানকে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, রোফায়েদ হাসানসহ ২৫–৩০ জন আন্দোলনকারীকে হত্যাচেষ্টা করা হয়।
নজরুল ইসলাম মজুমদার ও নাসা গ্রুপ: শিল্পবিপ্লব থেকে বিতর্কের কেন্দ্র : বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে গার্মেন্টস বিপ্লবের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত নজরুল ইসলাম মজুমদার। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত NASSA Group (NASSA Global Holdings Ltd) দেশের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিমুখী শিল্পগোষ্ঠী।
গ্রুপটির অধীনে রয়েছে —Nassa Apparels Ltd, Nassa Taipei Textiles, Nassa Builders, Nassa Properties, Nassa Securities, Nassa Travels & Nassa Foundation. এছাড়া তিনি ছিলেন EXIM ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ব্যাংকিং সেক্টরে এক সময়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার নাম এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে —২০২৪ সালের মাঝামাঝি দুদক তার বিরুদ্ধে ৭৮১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা করে।
দুদক বলেছে, নজরুল ইসলাম মজুমদার সরকারি প্রভাব ও ব্যাংকিং সংযোগ ব্যবহার করে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন এবং বিদেশে অর্থ স্থানান্তরেরও অভিযোগ রয়েছে।
আর্থিক সংকটে জর্জরিত নাসা গ্রুপ : গ্রুপটির অন্তর্ভুক্ত একাধিক পোশাক কারখানা বর্তমানে বেতনবকেয়া, ঋণ সংকট ও কার্যক্রম স্থগিত অবস্থায়। শ্রমিকদের কয়েক মাসের বেতন বকেয়া থাকায় চলতি বছর সরকার ও বিজিএমইএকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।
কারাগারে থাকা অবস্থাতেই নজরুল ইসলাম মজুমদার কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধের জন্য কিছু সম্পদ বিক্রির অনুমোদন দেন — যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল এক দৃষ্টান্ত।
ব্যাংকিং সেক্টর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্সিম ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নাসা গ্রুপের আর্থিক দায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার মতো। এর একটি বড় অংশ অনাদায়ী ঋণ হিসেবে তালিকাভুক্ত।
দেশ টিভির এমডি আরিফ হাসান: ক্ষমতার আড়ালে মিডিয়া প্রভাব : দেশ টিভি দেশের অন্যতম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল। এর এমডি আরিফ হাসান দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানিয়েছে।
তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে, যার মধ্যে আর্থিক অনিয়ম, কর ফাঁকি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে।
তাকে গত বছরের ১৭ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় এবং এরপর থেকে তিনি পাঁচটি মামলায় অভিযুক্ত।
শিল্পপতিদের ক্ষমতার জাল ভাঙছে : নাসা গ্রুপের মতো বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার দেখানোর ঘটনা বাংলাদেশের কর্পোরেট সংস্কৃতিতে বড় বার্তা দিয়েছে।
একসময় যাঁরা ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ করতেন, তারাই এখন অভিযুক্ত — এটি অর্থনৈতিক নৈতিকতার নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে।
শ্রমিক ও বিনিয়োগ ঝুঁকি : নাসা গ্রুপে হাজারো শ্রমিকের কর্মসংস্থান রয়েছে। চেয়ারম্যানের দীর্ঘ কারাবাসের ফলে উৎপাদন বন্ধ, বেতন বকেয়া, রপ্তানি চুক্তি বাতিলসহ একাধিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
এটি দেশের তৈরি পোশাক খাতে এক নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
মিডিয়া ও ন্যায়ের সীমানা : একই দিনে মিডিয়া ও ব্যবসায় জগতের দুই প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালতের এমন সিদ্ধান্ত— এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, প্রভাব ও দায়িত্বের নতুন বিতর্ক উসকে দিয়েছে।
দেশ টিভির ভবিষ্যৎ পরিচালনা, সম্পাদকীয় নীতি ও আর্থিক স্থিতি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
রাষ্ট্র ও আইনের পুনর্গঠন : জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় কাঠামো এখন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এই মামলাগুলো শুধু ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, বরং ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন— যার ফলশ্রুতিতে নতুন আইনি ভারসাম্যের সূচনা হতে পারে।
উপসংহার : নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদার ও দেশ টিভির এমডি আরিফ হাসানের গ্রেপ্তার দেখানো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও গণমাধ্যম অঙ্গনে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত তৈরি করেছে। এটি প্রমাণ করছে— আইন ও বিচার প্রক্রিয়া এখন ধীরে ধীরে প্রভাবশালী শ্রেণির প্রতিও প্রয়োগ হচ্ছে।
তবে এটি কেবল শুরু। প্রকৃত প্রশ্ন হলো — এই মামলাগুলোর পূর্ণ তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে কি সত্যিকারের জবাবদিহি নিশ্চিত হবে, নাকি আবারও অর্থ ও প্রভাবের জালে তা থেমে যাবে?
