দুদকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা  : ইসলামী ব্যাংকের ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারে এস আলম গ্রুপ

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক :  বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা হতে যাচ্ছে এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম, তার স্ত্রী, পাঁচ ভাইসহ মোট ৬৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।


বিজ্ঞাপন

রোববার দুদকের সহকারী পরিচালক মো. তানজির আহমেদ বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, এটি দুদকের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মামলা।

ইসলামী ব্যাংককে ‘নিজস্ব প্রতিষ্ঠান’ বানিয়ে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ :  দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি-নিষেধ, নীতিমালা ও পরিপত্র উপেক্ষা করে আসামিরা যোগসাজশে তিনটি প্রতিষ্ঠান— এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এস আলম স্টিলস লিমিটেড এবং এস আলম ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড—এর নামে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে আত্মসাৎ করেছেন।


বিজ্ঞাপন

এর বিপরীতে রাখা হয়েছে অপ্রতুল জামানত, যা ব্যাংক ও আমানতকারীদের অর্থকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।


বিজ্ঞাপন

ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন :  ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে বিনিয়োগ কার্যক্রমে একের পর এক অনিয়ম ঘটে।

২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ঋণসীমা ২,৪০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩,৮০০ কোটি টাকায় উন্নীত করে, যা ব্যাংকের মূলধনের ৩৫ শতাংশ অতিক্রম করে।

এটি স্পষ্টভাবে ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের একক গ্রাহক ঋণসীমা নীতিমালা লঙ্ঘন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুর্বল কোম্পানিকে অবৈধভাবে ঋণ : দুদক জানায়, ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্টে দেখা যায়, ঋণগ্রহীতা কোম্পানির দায় ইতিমধ্যে অতিরিক্ত এবং আইসিআরআরএস স্কোর ৫০ শতাংশের নিচে। তবুও ঋণ বৃদ্ধি ও নবায়নের অনুমোদন দেওয়া হয়।

এমনকি কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক আয় সন্তোষজনক না থাকা এবং জামানতের অনুপাত ৪০ থেকে ৭০ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকা সত্ত্বেও ঋণ নবায়ন করা হয়।

ব্যাংকের ভেতরে প্রভাব বিস্তার ও সফটওয়্যার কারসাজি : দুদক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রশাসন, আইটি বিভাগ ও পরিচালনা পর্ষদে আত্মীয় ও অনুগত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেন, যাতে তারা তার নির্দেশ অনুযায়ী ঋণ অনুমোদন ও সফটওয়্যার পরিবর্তন করতে পারে।

সাবেক ডিএমডি তাহের আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে আইসিটিডব্লিউ শাখার ‘টর্চ সফটওয়্যার’-এ ম্যানিপুলেশন করে ঋণের সীমা ও মেয়াদ পরিবর্তন করা হয়। এই কারসাজির মাধ্যমে প্রায় ৫,৯০০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয় বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

নামমাত্র প্রতিষ্ঠানের আড়ালে অর্থ পাচার : অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৩৪টি ঋণের মাধ্যমে মোট ৯,২৮৩.৯৩ কোটি টাকা আহসান এন্টারপ্রাইজ, ইমপ্রেস কর্পোরেশন, অ্যাপারচার ট্রেডিং, ইউনিক ট্রেডার্সসহ নামমাত্র প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।

পরে এই অর্থ এস আলম গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে—যেমন সোনালী ট্রেডার্স, গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন, এস এস পাওয়ার, এস আলম স্টিলস, এস আলম সিমেন্ট, এস আলম ভেজিটেবল অয়েল ইত্যাদির হিসাবে জমা হয়।

সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচার :  দুদকের তদন্তে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার এস আলম ট্রেডিং কোম্পানির হিসাব থেকে ৩৭ কোটি টাকা রূপালী ব্যাংকের ওআর নিজাম রোড শাখার গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশনে স্থানান্তর করা হয়।

পরদিন ওই প্রতিষ্ঠানের হিসাবে থাকা অর্থ থেকে ২৩.৫৮ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৯০ কোটি টাকা) ব্যাংক অব চায়নার সিঙ্গাপুর শাখায় এস এস পাওয়ার-১ লিমিটেডের অফশোর অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়।

দুদকের ভাষ্যমতে, এটি ছিল একটি পরিকল্পিত অর্থ পাচার প্রক্রিয়া, যা ব্যাংকের সফটওয়্যার কারসাজির মাধ্যমে গোপনে সম্পন্ন করা হয়।

অভিযোগের সারমর্ম :  দুদকের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— “আসামিরা ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ, জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের সফটওয়্যারে কারসাজি করে অনুমোদনহীন ঋণ প্রদান করেছেন এবং মোট **৯,২৮৩.৯৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন। বর্তমানে সুদ-আসলে এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০,৪৭৯.৬২ কোটি টাকা।”

দুদকের মন্তব্য : দুদকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “এই মামলাটি শুধু অর্থ আত্মসাতের নয়—এটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সুপরিকল্পিত ‘কর্পোরেট দখল ও অর্থ পাচারের’ একটি দৃষ্টান্ত। এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংককে নিজেদের অর্থের যন্ত্রে পরিণত করেছিল।”

তিনি আরও জানান, মামলাটি দুদকের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ অর্থ পাচার মামলা হিসেবে রেকর্ড হবে।

বিশ্লেষণ: ব্যাংক খাতে নিয়ন্ত্রণ সংকট ও কর্পোরেট দখলের বাস্তবতা : এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে দুদকের এই মামলা বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা ও তদারকি ঘাটতির এক নগ্ন উদাহরণ।

ইসলামী ব্যাংক দীর্ঘদিন দেশের অন্যতম ‘বিশ্বস্ত’ বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে নিয়ন্ত্রণ বদলের পর ব্যাংকটির আর্থিক নীতি, ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়া ও পরিচালনা কাঠামো ধীরে ধীরে একটি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী-কেন্দ্রিক ক্ষমতার বলয়ে পরিণত হয়।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এস আলম গ্রুপের প্রভাব কেবল ইসলামী ব্যাংকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না—তারা একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বন্দর ব্যবসা, বিদ্যুৎ প্রকল্প, আমদানি-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোতেও প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করেছে।

এই মামলার ফলে একদিকে যেমন আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের প্রশ্ন উঠেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদারকি ব্যর্থতার দায় নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের কেলেঙ্কারি ব্যাংকিং খাতে লিকুইডিটি সংকট, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং আর্থিক নৈতিকতা ধসের ঝুঁকি তৈরি করে। তাদের মতে,  “যদি বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর আর্থিক অপরাধের বিচার না হয়, তবে রাষ্ট্রের আর্থিক শৃঙ্খলা চিরস্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

উপসংহার : দুদকের এই মামলার মাধ্যমে পুনরায় প্রমাণিত হলো—বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক প্রভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও কর্পোরেট দখলদারিত্ব এখন বড় ধরনের আর্থিক নিরাপত্তা হুমকিতে পরিণত হয়েছে।

এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে এই মামলা শুধু একটি অর্থ পাচারের গল্প নয়—এটি বাংলাদেশের আর্থিক খাতের নৈতিকতা, তদারকি ও জবাবদিহিতার পরীক্ষার মুহূর্ত।

👁️ 117 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *