শরণখোলায় ধ্বংসস্তূপের মাঝে মানবিকতার আলো জ্বেলেছিল ‘হ্যান্ডস অন’

Uncategorized খুলনা গ্রাম বাংলার খবর জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন মানবিক খবর সারাদেশ

​নইন আবু নাঈম তালুকদার (শরণখোলা)  :  উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে আঘাত হানে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। দেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ এই দুর্যোগে হাজারো মানুষের প্রাণহানি ঘটে, ধ্বংস হয় লক্ষাধিক ঘরবাড়ি, ফসল ও জীবিকা। উপকূলীয় বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলা ছিল সিডরের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর একটি। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা এই জনপদে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে গ্রামগুলো পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ও পানীয় জলের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।


বিজ্ঞাপন

এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায় আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা সংস্থা “হ্যান্ডস অন ডিসাস্টার রেসপন্স” (Hands On Disaster Response – HODR)।
​সিডর পরবর্তী সময়ে যখন শরণখোলাসহ উপকূলীয় অঞ্চল গুলোতে মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে, তখন HODR দ্রুত মাঠে নামে। সংস্থাটি প্রথমেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য জরুরি ত্রাণ বিতরণ, চিকিৎসা সহায়তা এবং অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সিডরে প্রায় সাড়ে চার লক্ষাধিক ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে HODR গৃহহীন পরিবারগুলোর জন্য ঘর নির্মাণে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে সংস্থাটি ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করে।

ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর শরণখোলায় শিশুদের মানসিক সহায়তা এবং নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সেফ দ্য চিলড্রেন (Save the Children) এবং হ্যান্ডস অন (Hands On) যৌথভাবে শিশুদের জন্য বিশেষ “চাইল্ড-ফ্রেন্ডলি স্পেস” (Child-Friendly Spaces) বা শিশু কেন্দ্র স্থাপন করেছিল।
​HODR স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবকদেরও যুক্ত করে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে। ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার, অবকাঠামো মেরামত, পানীয় জলের উৎস পুনঃস্থাপন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানে তারা নিরলসভাবে কাজ করেন। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিচালিত এই কার্যক্রম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে ওঠে।


বিজ্ঞাপন

মানবিক সহায়তা, তথ্য পুনরুদ্ধার এবং পুনর্বাসন কার্যক্রমে বিদেশি স্বেচ্ছাসেবীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। HODR-এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত Humanitarian Disaster Data Recovery (HDDR) কার্যক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ৭৫ জন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক অংশ নেন। আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও আয়ারল্যান্ডসহ ১৮টি দেশের নাগরিকরা এই দলে ছিলেন। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত এই দলটি সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল থেকে গুরুত্বপূর্ণ মানবিক ও ভৌগোলিক তথ্য সংগ্রহ ও বিন্যস্ত করে, যা পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।


বিজ্ঞাপন

এই আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দল স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছে দেয় এবং ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো মেরামতে স্থানীয়দের সহায়তা করে। তাদের নিঃস্বার্থ সেবা ও পেশাদারিত্ব সিডর পরবর্তী বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সংহতি ও মানবিক চেতনার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

বর্তমানে “হ্যান্ডস অন ডিসাস্টার রেসপন্স” (HODR) সংস্থাটি “অল হ্যান্ডস অ্যান্ড হার্টস” (All Hands and Hearts – AHAH) নামে পরিচিত। ২০১৭ সালের শেষের দিকে ‘অল হ্যান্ডস ভলান্টিয়ার্স’ (All Hands Volunteers) এবং ‘হ্যাপি হার্টস ফান্ড’ (Happy Hearts Fund) একীভূত হয়ে এই নতুন সংস্থাটি গঠন করে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় HODR নামে পরিচিত এই সংস্থাটি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করছে, মানবিক সহায়তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে।

শরণখোলায় সিডরের ক্ষত সারাতে “হ্যান্ডস অন ডিসাস্টার রেসপন্স”-এর ভূমিকা শুধু ত্রাণ কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ছিল মানবিক সহমর্মিতা, আন্তর্জাতিক সংহতি ও পুনর্গঠনের এক বাস্তব উদাহরণ। তাদের উদ্যোগে শরণখোলার মানুষ নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল, যা আজও দুর্যোগ মোকাবিলায় অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

👁️ 61 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *