
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নপত্র ফাঁসের নেপথ্যের কারিগর।

বিশেষ প্রতিবেদক : সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ (২০২৫–২৬) ঘিরে চলমান অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এখন আর গুঞ্জন নয়—এটি পরিণত হয়েছে দেশের শিক্ষিত বেকার সমাজের জন্য এক দুঃস্বপ্নে। মেধা, যোগ্যতা ও কঠোর পরিশ্রমকে উপেক্ষা করে টাকার বিনিময়ে চাকরি বাণিজ্যের অভিযোগ দীর্ঘদিনের হলেও সাম্প্রতিক নিয়োগ কার্যক্রমে সেই অভিযোগ আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
ভুক্তভোগী প্রার্থীদের অভিযোগ, একটি সংঘবদ্ধ দালালচক্র ও কিছু অসাধু মহলের যোগসাজশে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। এতে প্রকৃত মেধাবী ও পরিশ্রমী প্রার্থীরা বারবার বঞ্চিত হচ্ছেন, আর চাকরি পাচ্ছেন ‘আগাম লেনদেনের’ মাধ্যমে নির্বাচিতরা।

একাধিক শিক্ষিত বেকার তরুণ জানান, বছরের পর বছর ধরে নিরলস পড়াশোনা ও প্রস্তুতির পরও তারা চাকরি পাচ্ছেন না। এতে তরুণ সমাজের মধ্যে হতাশা ভয়াবহভাবে বেড়ে চলেছে এবং রাষ্ট্রীয় নিয়োগ ব্যবস্থার ওপর আস্থা ক্রমেই ভেঙে পড়ছে। প্রশ্ন উঠছে—এই দুর্নীতিগ্রস্ত বাস্তবতায় শিক্ষিত বেকারদের সঙ্গে প্রহসন কি কারও চোখে পড়ে না? পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগে বাতিল—চরম ভোগান্তি !


বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের ২৬ তারিখ বিকেলে অনুষ্ঠিতব্য প্রাথমিকের হিসাব সহকারী পদের পরীক্ষাটি প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে পরীক্ষা শুরুর ঠিক এক ঘণ্টা আগে বাতিল করা হয়। এতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় আসা হাজারো পরীক্ষার্থী চরম বিপাকে পড়েন—অর্থনৈতিক ক্ষতি ও মানসিক ধাক্কা দুই-ই বহন করতে হয় তাদের।
একইভাবে খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষাতেও প্রশ্নফাঁস নিয়ে একাধিক অভিযোগ সামনে এসেছে। পরীক্ষার্থীদের দাবি, বুয়েটের অধীনে প্রণীত প্রশ্নপত্রগুলো ধারাবাহিকভাবে ফাঁস হচ্ছে। এমনকি গুঞ্জন রয়েছে, আগামী ২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য সহকারী শিক্ষক পরীক্ষার আসন (সিট) আগাম বুক করা এবং প্রশ্নফাঁসের প্রবল আশঙ্কাও রয়েছে। এই বাস্তবতা মেধাবী শিক্ষার্থীদের হতাশা কতটা গভীরে পৌঁছেছে, তারই প্রতিফলন। প্রশ্ন উঠছে—মেধাবীদের মূল্যায়ন আর কবে হবে?

নির্বাচনী তফসিল ও নিরাপত্তা ঝুঁকি : এদিকে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর সাধারণত যেখানে পরীক্ষা নেওয়ার স্পষ্ট নির্দেশনা থাকে না, সেখানে বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষা দেওয়া একজন শিক্ষার্থীর জন্য কতটা নিরাপদ—সে প্রশ্নও জোরালোভাবে উঠছে।
শিক্ষাবিদদের সতর্কবার্তা : শিক্ষাবিদদের মতে, প্রাথমিক স্তরে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ হলে তার নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে পুরো জাতিকে বহন করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধ না হলে বেকার সমাজের হতাশা আরও গভীর হবে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়বে।
শিক্ষার্থীদের স্পষ্ট দাবি : এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষিত বেকার ও পরীক্ষার্থীরা কয়েকটি সুস্পষ্ট দাবি তুলে ধরেছেন— সুষ্ঠু পরীক্ষা নিশ্চিত ও প্রশ্নফাঁস রোধে সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অবিলম্বে বুয়েটের অধীন থেকে সরিয়ে পিএসসির অধীনে নেওয়া হোক। পরীক্ষা যাতে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয়, সে লক্ষ্যে যে পদক্ষেপগুলো প্রয়োজন তা অনতিবিলম্বে গ্রহণ করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের বারবার বিপাকে পড়তে না হয়।
নির্বাচনী সময়কাল ও রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে নিয়োগ পরীক্ষাগুলো সাময়িকভাবে পিছিয়ে দেওয়া হোক। প্রশ্নফাঁস ও নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

সচেতন নাগরিক সমাজের আহ্বান : সচেতন নাগরিক সমাজ দ্রুত, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত, কঠোর নজরদারি ও দালালচক্র নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
শেষ কথা : সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি শিক্ষার্থীদের কঠিন আবেদন—এই সংকটময় সময়ে শিক্ষার্থীদের মুখের দিকে তাকিয়ে, অন্তত জুলাইয়ের আত্মত্যাগকে সম্মান করে, অসদুপায় রোধ করুন। প্রকৃত মেধাবীদের স্বপ্ন যেন আর ঝরে না পড়ে, সে লক্ষ্যে একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
শিক্ষার্থীদের দাবি, ২ জানুয়ারির সহকারী শিক্ষক পরীক্ষা আপাতত স্থগিত করে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অন্যথায় দেশের এই অন্ধকার বাস্তবতায় শিক্ষিত বেকাররা আজীবন হতাশা ও অনিশ্চয়তার গহ্বরে গড়াগড়ি খাবে।
একটি সুন্দর, মানবিক ও শিক্ষিত সমাজ গড়তে হলে নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ করতেই হবে। প্রকৃত মেধার বিকাশ হোক—এটাই এখন সময়ের দাবি।
