নুরানী চেহারায় অসম্ভবকে সম্ভব

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র স্বাস্থ্য

স্বাস্থ্যের স্বঘোষিত কর্নধার ড্রাইভার

মালেক দুই মামলায় ১৪ দিনের রিমান্ডে

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : কি সুন্দর চেহারা! মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি। কপালে কালো দাগ। সামনে দেখলে যে কেউ বলবেন, একজন খাটি ইমানদার মানুষ। কিন্তু তা-না! এই নূরানী সুন্দর চেহারার ভেতরেই অসংখ্য দুর্নীতি, কুকৃর্তির কাহিনী লুকিয়ে ছিল। যা র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর ভুক্তভোগিরা গোমর ফাঁস করছেন।
তার নাম আব্দুল মালেক, পেশায় একজন গাড়িচালক। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে করতেন চাকুরি। আলাদ্বীনের চেরাগ পেয়ে এখন তিনি শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক। কোট কোটি টাকা তার পড়ে আছে ব্যাংকে।আবার ১০ তলা, ৭ তলার বিলাশ বহুল বাড়ি, অর্ধশত ফ্ল্যাট, ডেইরী ফার্মসহ নানা প্রজেক্টের মালিক তিনি। তার গ্রেফতার এবং অঢেল অর্থ সম্পদের খবর শুনে সাধারণ মানুষ চোখে মুখে অন্ধকার দেখা শুরু করছেন। কি করে এমন অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, তা জানার অপেক্ষা করছেন দেশের সাধারণ মানুষ।
জানা গেছে, শত কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক ডিজির গাড়ি চালক মালেক গ্রেফতারের পর তার অপকর্মগুলো একে একে ফাঁস হচ্ছে। শুধু তাই নয়, র‌্যাবের অভিযানে তিনি গ্রেফতারের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভুক্তভোগি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একে অপরকে মিষ্টিমুখও করিয়েছেন বলে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন কর্মচারী জানিয়েছেন। তারা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হলেও তিনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একে জায়গায় থেকে অন্য জায়গা বদলি বাণিজ্য করতেন। আবার স্বাস্থের বিভিন্ন দপ্তরে তদবির করিয়ে দেওয়ার নাম করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আনুকূল্যে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের গাড়ি চালক আব্দুল মালেক র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে নানা তথ্য বের হয়ে আসছে। তিনি অবৈধের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চাঁদা করথেন। আবার জাল নোটের ব্যবসা ছাড়াও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত।
র‌্যাব সূত্র জানায়, গত রোববার মালেক গ্রেফতার হওয়ার পর র‌্যাবের প্রার্থমিক জিজ্ঞিাসাবাদে তিনি তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হলেও বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক বনে গেছেন। তার দুটি সাততলা ভবন রয়েছে।আর নির্মাণাধীন একটি ১০ তলা ভবন, জমি, গরুর খামার ও বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ গচ্ছিত অর্থের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব।তার সম্পদের অর্থমূল্য শত কোটি টাকারও বেশি রয়েছে।
র‌্যাব জানায়, গত রোববার বিকালে রাজধানীর তুরাগ থানার বামনারটেক এলাকার একটি সাততলা ভবন ভবনে অভিযান চালিয়ে আব্দুল মালেককে গ্রেফতার করে। তাকে গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ জাল বাংলাদেশি টাকা, একটি ল্যাপটপ ও একটি মোবাইল উদ্ধার করে র‌্যাব।
ড্রাইভার মালেক গ্রেফতারের পর র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের গাড়িচালক ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী আবদুল মালেক অষ্টম শ্রেণী পাস। তিনি ১৯৮২ সালে প্রথম সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পের গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ পান। এর বছর চারেক পর অধিদপ্তরের পরিবহন পুলে যোগ দেন। গাড়িচালক আব্দুল মালেক গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত প্রেষণে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের গাড়িচালক ছিলেন। অবৈধ অস্ত্র আর স্বাস্থেল ডিজি’র ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তিনি বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে যান। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক ডিজিসহ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আস্থাভাজন ছিলেন তিনি। আর সেই আস্তাভাজনের সুবাদে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন।
আদালত সূত্র জানায়, গাড়িচালক আব্দুল মালেক ওরফে মালেক ড্রাইভারকের বিরুদ্ধে রাজধানীর তুরাগ থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়।এই দুই মামলায় ৭দিন করে মোট ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। সোমবার ঢাকা ম্যাট্রেপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলাম শুনানি শেষে রিমান্ডের এই আদেশ দেন।
তুরাগ থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুষ্ঠু তদন্তের প্রয়োজনে অবৈধ অস্ত্র ও জাল টাকার ব্যবসার মামলায় সাত দিন করে মোট ১৪ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে আদালতে হাজির করেন মালেক ড্রাইভারকে।এ সময় আসামি পক্ষের আইনজীবী জিএম মিজানুর রহমান রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। আর রাষ্ট্রপক্ষ ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু এর বিরোধিতা করেন।আদালতে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক রিমান্ডের এ আদেশ দেন।এরআগে সোমবার দুপুর ২টার দিকে আব্দুল মালেককে আদালতে হাজির করা হয়। পরে তাকে হাজত খানায় রাখা হয়।বেলা ৩টায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রট আদালত-৭এর এজলাসে হাজির করা হয় তাকে। তারপর শুনানি শুরু হয়।
র‌্যাব সূত্র জানায়, স্বাস্থ্যের সাবেক ডিজির ‘ড্রাইভার মালেকের বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, জাল টাকার ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি এলাকায় সাধারণ মানুষকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে শক্তির মহড়া ও দাপট প্রদর্শনের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কয়েক করেছিল। এতে এলাকায় জনজীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ড্রাইভার মালেকের প্রতিবেশী এক ভুক্তভোগি জানান, মালেকের স্ত্রীর নামে রাজধানীর দক্ষিণ কামারপাড়ায় ২টি সাততলা বিলাসবহুল ভবন করা হয়েছে। আর ধানমন্ডির হাতিরপুল এলাকায় ৪.৫ কাঠা জমিতে একটি নির্মাণাধীন ১০তলা ভবন করা হয়েছে। এছাড়া তুরাগের দক্ষিণ কামারপাড়া এলাকায় ১৫কাঠা জমিতে একটি ডেইরি ফার্ম করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রয়েছে।
অপর সূত্র জানায়, গাড়ি চালক দুটি বিয়ে করেছেন। তার প্রথম স্ত্রীর নাম নার্গিস আক্তার। তার নামে তুরাগ থানাধীন দক্ষিণ কামারপাড়া রমজান মার্কেটের উত্তর পাশে ছয় কাঠা জায়গার ওপর সাততলার (হাজী কমপ্লেক্স) দুটি আবাসিক বিল্ডিং করা হয়েছে। ওই বিল্ডিংয়ে মোট ২৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে।এছাড়াও আনুমানিক আরও ১০/১২ কাঠার প্লট রয়েছে। এই ভবনের তৃতীয় তলায় বসবাস করেন গাড়ী চালক মালেক। বাকি ফ্ল্যাটগুলোর কয়েকটি ভাড়া দেওয়া রয়েছে। আবার তার মেয়ে বেবির নামে দক্ষিণ কামারপাড়া ৭০ নম্বর রাজাবাড়ী হোল্ডিংয়ে প্রায় ১৫কাঠা জায়গার ওপর ‘ইমন ডেইরি ফার্ম’ নামে একটি গরুর খামার রয়েছে। সেখানে প্রায় ৫০টি বাছুরসহ গাভী রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরে ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন তৈরি করে নিজে সেই সংগঠনের সভাপতি হয়েছেন। এই পদের ক্ষমতাবলে তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের ড্রাইভারদের ওপর একছত্র আধিপত্য কায়েম করেছেন। ভুক্তভোগিরা জানান, মারেক ড্রাইভারদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করতেন। আর তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক প্রশাসনকে জিম্মি করে বিভিন্ন ডাক্তারদের বদলি ও পদোন্নতি এবং তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছেন।
আরেক সূত্র জানায়, ড্রাইভার মালেক তার মেয়ে নৌরিন সুলতানা বেলিকে অফিস সহকারী পদে, ভাই আব্দুল খালেককে অফিস সহায়ক পদে, ভাতিজা আব্দুল হাকিমকে অফিস সহায়ক পদে, বড় মেয়ে বেবির স্বামী রতনকে ক্যান্টিন ম্যানেজার হিসেবে, ভাগ্নে সোহেল শিকারীকে ড্রাইভার পদে, ভায়রা মাহবুবকে ড্রাইভার পদে, নিকট আত্মীয় কামাল পাশাকে অফিস সহায়ক পদে স্বাস্থ্য অধিদফতরের চাকরির ব্যবস্থা করেছেন।
আবার ড্রাইভার মালেক নিজে গাড়িচালক হলেও মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দকৃত একটা সাদা পাজেরো জিপ গাড়ি (গাড়ি নং ঢাকা মেট্রো গ-১৩-২৯৭৯) নিয়মিত ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে থাকেন। তাছাড়া, মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দকৃত পাজেরো গাড়ি ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদফতরের আরও দুটি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। এরমধ্যে একটি পিকআপ গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঠ-১৩-৭০০১) তিনি নিজের গরুর খামারের দুধ বিক্রি এবং মেয়ের জামাইয়ের পরিচালিত ক্যান্টিনের মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহার করতেন। অপর একটি মাইক্রোবাস (গাড়ি নং ঢাকা মেট্রো চ- ৫৩-৬৭৪১) স্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্মরত তার পরিবারের অন্য সদস্যরা ব্যবহার করতেন। শুধু তাইন নয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরে সিন্ডিকেট করে সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় ও বিদেশে পাচার এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের উপ-পরিচালক মো. সামছুল আলম গত বছরের ২২ অক্টোবর তাকে দুদকে তলব করেন। তবে তার বিরুদ্ধে দুদক এখনও অনুসন্ধান শেষ করতে পারেনি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমে বলেছেন, গ্রেফতারকৃত ড্রাইভার মালেক তার গাড়ি চালক ছিলেন না। তিনি স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. এএইচএম এনায়েত হোসেনের চালক ছিলেন। গত মার্চ মাসে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে মালেক গাড়ি চালানো বন্ধ রেখেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতর একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
হেলথের ডিজির গাড়িচালকের বিষয়ে স্বাস্থ্য সচিব মো. আবদুল মান্নান বলেন, সার্ভিস রোলে যে বিধান আছে সে অনুযায়ী ডিজি বলেছে তিনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন। দুদক আছে তারা দেখবে। তবে তার ছাড় পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আরও যারা এমন আছে তাদের বিষয়ে অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া রয়েছে। গত কয়েক মাসে স্বাস্থ্য বিভাগে কোনো ধরনের অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির সাথে যেই জড়িত কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। আমরা কাউকে ছাড়তে চাচ্ছি না। তবে সেই ড্রাইভারকে বরখাস্ত করার দায়িত্ব ডিজির। তাকে বরখাস্ত করতে আজকের দিন পার হওয়ার কথা না।


বিজ্ঞাপন