শিকায় উঠছে স্বাস্থ্যবিধি!

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন

রাজধানী ছাড়ছেন ঘরমুখী মানুষ, বেসামাল ঘাট কর্তৃপক্ষ


বিজ্ঞাপন

বিশেষ প্রতিবেদক : করোনা ঝুঁকির তোয়াক্কা না করেই রাজধানী ছাড়ছেন ঘরমুখী মানুষ। ঢল নেমেছে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে। গ্রামে যেতে মরিয়া যাত্রীরা গাদাগাদি করেই ছোট লঞ্চে পার হচ্ছেন উত্তাল পদ্মা। এদিকে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে প্রতিদিন সকাল থেকে মানুষ ভিড় করতে শুরু করেছে লঞ্চঘাটে। সামাজিক দূরত্ব মানা দূরের কথা মাস্ক থুতনিতে বা গলায় ঝুলিয়ে লঞ্চঘাটে ভিড়ছেন মানুষ।
লঞ্চঘাট কর্তৃপক্ষের নজরদারি উপেক্ষা করে ঢোকার সময় স্বাস্থ্যবিধি মানলেও ভিতরে এসে গাদাগাদি করে মাস্ক খুলে বসে বা দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছেন। অন্যদিকে গাদাগাদি করে যাত্রী বহনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেটি উপেক্ষা করে ঢাকা নদীবন্দর থেকে ছেড়ে গেছে বেশির ভাগ লঞ্চ। বিআইডব্লিউটিএ ঢাকা নদী বন্দর কর্তৃপক্ষ সর্বাত্মক চেষ্টা করেও পারছেন না সঠিক ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদে লঞ্চে যাত্রী পরিবহন করতে।
রোববার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, দল বেধে পরিবারসহ মানুষ আসছেন লঞ্চঘাটে। গেটে বিআইডিডব্লিউটিএ’র লোকজনের নির্দেশে মুখে মাস্ক পরে তাপমাত্রা পরিমাপ করে টার্মিনালে প্রবেশ করছেন যাত্রীরা। তবে ভিতরে ঢোকার পর আর স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। লঞ্চঘাটে আসা যাত্রীরা চাঁদপুর, বরিশাল, পটুয়াখলী, হাতিয়া এবং ভোলার উদ্দেশে রওনা হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকার উদ্দেশে আসা লঞ্চের মধ্যেও ছিল অনেক ভিড়। লঞ্চের ডেকে বসা বেশির ভাগ যাত্রীর মুখে নেই কোনো মাস্ক। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে একে অপরের গা ঘেঁষে লঞ্চের ডেকে গাদাগাদি করে বসে আছেন। কিছু কিছু লঞ্চের সামনে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখলেও অনেক যাত্রী সেটি ব্যবহার করছেন না।
টার্মিনালের গেটে দায়িত্ব পালন করা ঢাকা নদী বন্দরের শুল্কপ্রহরী মো. রোকন বলেন, আমরা মাস্ক ছাড়া কাউকে টার্মিনালের ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছি না। সামাজিক দূরত্ব মেনে যাতে সবাই চলাচল করে সেদিকে খেয়াল রাখছি। যাত্রী বা যারা লঞ্চের মধ্যে কাজ করছেন তারা স্বাস্থ্য বিধি মানছেন না।
এমভি পূবালী-৬ এর দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য জামাল বলেন, লঞ্চে প্রবেশকালে যাত্রীদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার ও মাস্ক পরে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ডেকে বসার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু যাত্রীরা সেটি মানছেন না।
মানিক নামে এক যাত্রী অত্যন্ত ক্ষিপ্ত সুরে বলেন, লঞ্চের লোকজন ইচ্ছে করেই স্বাস্থ্য বিধিতে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এক ঘণ্টা হলো এখানে আছি অথচ কারো হাতে হ্যান্ড স্যানেটাইজার দেওয়া কিংবা কারও মাস্ক না পরার কারন জিজ্ঞেস করতে দেখি নি। ভিতরের অবস্থাও একই রকম সবাই গাদাগাদি করে বসে আছে।
ঢাকা থেকে ভোলার উদ্দেশ্য যাওয়া কর্ণফুলী-১০ এর সুপারভাইজার শাহজাহান বলেন, আমরা লঞ্চের ভিতরে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষায় ডেকে দাগ দেখে দূরত্ব বজায় রেখে বসতে মাইকে বার বার বলছি। আমাদের লঞ্চ উঠতে গেলে যাত্রীকে অবশ্যই মাস্ক পড়তে হচ্ছে। স্টাফরা স্প্রে মেশিন দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর লঞ্চের ডেক জীবাণুমুক্ত করছেন। হ্যান্ড স্যানেটাইজার দিয়ে যাত্রীদের লঞ্চে উঠানো হচ্ছে। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের স্টেশনের বাইরে ভিতরে টহল দিতে দেখা গেছে।
এদিকে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করতে তৎপর রয়েছে নৌপুলিশ। লঞ্চ চলাচলের শুরু থেকেই সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে অতিরিক্ত নৌ-পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। লঞ্চে অর্ধেক যাত্রী নিশ্চিত করা এবং যাত্রীদের মাস্ক পরার বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিং করছেন তারা। মাস্ক ছাড়া কোনো যাত্রী টার্মিনালে প্রবেশ করতে পারছে না।
নৌ-পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা শতভাগ মাস্ক নিশ্চিত করতে কাজ করছি। লঞ্চের ভিতরে গিয়ে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মানতে উৎসাহ দিচ্ছি। যাদের মাস্ক নেই তাদেরকে মাস্ক সরবরাহ করছি। আমরা কেবল আমাদের দায়িত্বটুকু পালন করতে পারি। এ ব্যাপারে প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থার পরিচালক ও এমভি ইয়াদ লঞ্চের মালিক মামুন অর রশিদ বলেন, টার্মিনালে মাস্ক ছাড়া কোন যাত্রী প্রবেশ করবে না। প্রতিটি লঞ্চে তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র, জীবাণু নাশক স্প্রে, হ্যান্ড স্যানেটাইজার রক্ষিত আছে। যাত্রী থাকলেও ঈদের মতো যাত্রী নেই।
লঞ্চ বন্ধ রাখার চেয়ে অর্ধেক আসন খালি রেখে সরকার লঞ্চ চালাতে দেওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদও জানান তিনি।
নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন বলেন, আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে লঞ্চ পরিচালনা করতে আমরা বদ্ধপরিকর। লঞ্চমালিক, ডিএমপি পুলিশ, নৌ পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয় করে প্রতিটি লঞ্চে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি আমরা নজরদারি করছি। পাশাপাশি মাইকিং, ব্যানার, ফেস্টুন টাঙিয়ে আমরা যাত্রীদের মাস্কসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বিধি মানতে উৎসাহ দিচ্ছি। সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে ও মনিটরিং করছি। সর্বোপরি ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি। যেসব লঞ্চ স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, ঈদুল আজহা উদযাপন, জনসাধারণের যাতায়াত, ঈদ পূর্ববর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারিকৃত বিধিনিষেধ ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত শিথিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ওই প্রজ্ঞাপনের আলোকে ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে এবং প্রত্যেক যাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে মাস্ক পরিধান ও সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে নৌযান পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
স্বাস্থ্যবিধি মানছে না ঘরমুখো মানুষ : দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র ঈদুল আজহা। ফলে ঘরমুখো হচ্ছেন মানুষ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ বেড়েছে। কিন্তু বাসচালক, হেলপার ও যাত্রীরা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রোববার সকালে এমন চিত্র দেখা গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড ও শিমরাইল মোড়ে অন্যান্য পরিবহনের চেয়ে দূরপাল্লার বাস বেশি। যার কারণে বাস কাউন্টারের আশেপাশে গাড়ির জটলা লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে যাত্রীর চাপ বাড়লেও বাসের হেলপারদের অতিরিক্ত ভাড়া নিতে দেখা যায়নি।
আবুল কালাম নামে এক যাত্রী বলেন, আমি যাত্রাবাড়ী থেকে সাইনবোর্ড এলাম। এখন দাউদকান্দি যাব। রাস্তায় গাড়ির চেয়ে যাত্রী বেশি।
রাজিয়া বেগম নামে আরেক যাত্রী জানান, ভাড়া বেশি নিচ্ছে না। কিন্তু রাস্তায় মানুষ বেশি।
তিশা বাসের হেলপার রুহুল আমিন জানান, রাস্তায় যাত্রী বেশি ঠিকই কিন্তু আমরা অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছি না।
এ বিষয়ে কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উভয়মুখী গাড়ির চাপ বেড়েছে। বিকেলে গাড়ির পাশাপাশি যাত্রীদের চাপও বেশি থাকে।
ঈদে ফেরিঘাটে যাত্রীদের ঢল : করোনা ঝুঁকির তোয়াক্কা না করেই রাজধানী ছাড়ছেন ঘরমুখী মানুষ। ঢল নেমেছে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে। গ্রামে যেতে মরিয়া যাত্রীরা গাদাগাদি করেই ছোট লঞ্চে পার হচ্ছেন উত্তাল পদ্মা।
লঞ্চ চালু সত্ত্বেও ফেরিতে ঘরমুখী মানুষের ঠাসা ভিড় দেখো গেছে। ফেরিতে যানবাহনের চেয়ে যাত্রীই বেশি। বাড়তি চাপ সামলা দিতে চাঁদপুর থেকে ফেরি কাকলী ও কলমীলতা যুক্ত করা হয়েছে বহরে। তারপরও হিমশিম খেতে হচ্ছে ঘাট কর্তৃপক্ষকে। লঞ্চঘাটে ভিড়লেই শুরু হচ্ছে উঠার হুড়োহুড়ি। বাড়ি যেতে মরিয়া যাত্রীদের কাছে তোয়াক্কা নেই স্বাস্থ্যবিধির।
মাওয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সিরাজুল কবির বলেন, অতিরিক্ত যাত্রী ও তাদের কাছ থেকে ভাড়া বেশি নিতে না পারে সে জন্য কাজ করে যাচ্ছি আমরা।
পদ্মার প্রবল স্রোতে অতিরিক্ত যাত্রীবহন করছে ছোট লঞ্চগুলো। এ রুটে ১৯টির মধ্যে ১৫টি ফেরি এবং ৮৭টি লঞ্চের মধ্যে চলাচল করছে ৮৪টি বলে জানান শিমুলিয়া বিআইডব্লিউটিএর সহকারী পরিচালক শাহদাৎ হোসেন।
বিআইডব্লিউটিসির সহমহাব্যবস্থাপক সফিকুল ইসলাম বলেন, সবকিছু মিলিয়ে ঈদে ঘরমুখো মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতেন পারেন তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
একই চিত্র পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটেও। পারাপারের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।