লন্ডভন্ড লকডাউন

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন স্বাস্থ্য

ঢাকামুখী মানুষের স্রোত, পদে পদে ভোগান্তি


বিজ্ঞাপন

বিশেষ প্রতিবেদক : একদিকে কঠোর লকডাউন, অন্যদিকে বন্ধ কর্মস্থল। যে কারণে লকডাউনের সময়ে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে গ্রামের বাড়িতে ঈদ উদযাপন করেন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। তবে লকডাউন চলাকালে হঠাৎ পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার খবরে এবার কর্মস্থলমুখী মানুষের ঢল নেমেছে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া এবং আরিচা ফেরিঘাট, বাংলাবাজার-শিমুলিয়া ফেরিঘাট, ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক এলাকায়। ফলে লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে কঠোর লকডাউন।
কঠোর বিধিনিষেধ শেষ হতে আরো ছয় দিন বাকি। এরমধ্যেই রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে সরকার। হঠাৎ এই সিদ্ধান্তে ঈদের সময় ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া শ্রমিকদের আবারও ঢাকামুখী ঢল নেমেছে। যদিও তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি বলেছেন, কারখানায় আসার সুযোগ থাকলে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেবেন। কেউ গ্রামে চলে গেলে লকডাউনের পর কাজে যোগ দিতে পারেন।
কঠোর বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে শনিবার ভোর থেকেই দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ও বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌপথে দেখা গেছে ঢাকামুখী যাত্রীদের ঢল। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা যাত্রীরা রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাটে পৌঁছেছেন হেঁটে, অটোরিকশায় কিংবা মাহেন্দ্রতে চড়ে। যানবাহন কম থাকলেও যাত্রীবোঝাই ফেরি ছেড়েছে এ ঘাট থেকে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেও ছিল ঢাকামুখী যাত্রী, ব্যক্তিগত ও ছোটগাড়ির চাপ।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা আঞ্চলিক কার্যালয়ের ডিজিএম জিল্লুর রহমান বলেছেন, জরুরি পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার করার জন্য সীমিত আকারে ফেরি সার্ভিস চালু রাখার নির্দেশনা রয়েছে। এর মধ্যে যাত্রী উঠে গেলে আমাদের কি করার আছে। মানবিক কারণে জরুরি পণ্যবাহী ট্রাকের সাথে এসব যাত্রীরা পারাপার হচ্ছে।
ঈদুল আজহার আগে-পরে আট দিন শিথিল রাখার পর সরকার ১৪দিনের কঠোর বিধি-নিষেধ জারি করেছিল, কিন্তু এই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনেই রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। কঠোর বিধি-নিষেধ শেষ হবে আগামী ৫ আগস্ট।
এদিকে তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমাদের আশা পূরণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড় ধরনের সাহসী উদ্যোগ নিয়েছেন। এর ফলে দেশের রপ্তানি খাত বড় ধরনের ঝুঁকি থেকে বেঁচে গেল। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।
তিনি বলেন, কারখানায় আসার সুযোগ থাকলে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেবেন। কেউ গ্রামে চলে গেলে লকডাউনের পর কাজে যোগ দিতে পারেন। কারো চাকরি যাবে না। ন্যায্য মজুরি থেকেও বঞ্চিত হবেন না।
শুক্রবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব রেজাউল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে রপ্তানিমুখী শিল্প খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায় সরকার। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ১ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে রপ্তানিমুখী সব শিল্প ও কলকারখানা আরোপিত বিধি-নিষেধের আওতাবহির্ভূত রাখা হলো।
পাটুরিয়ায় ঢাকামুখী মানুষের ঢল : একদিকে কঠোর লকডাউন, অন্যদিকে বন্ধ কর্মস্থল। যে কারণে লকডাউনের সময়ে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে গ্রামের বাড়িতে ঈদ উদযাপন করেন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা।
তবে লকডাউন চলাকালে হঠাৎ পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার খবরে এবার কর্মস্থলমুখী মানুষের ঢল নেমেছে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া এবং আরিচা ফেরিঘাট এলাকায়। শনিবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে পাটুরিয়া ফেরিঘাট এলাকার তিন নম্বর ফেরিঘাট পন্টুনে এমন চিত্র দেখা যায়।
যাত্রীবোঝাই করে পাটুরিয়া ফেরিঘাট এলাকার তিন নম্বর পন্টুনে নোঙর করে বড় ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান। ঢাকমুখী যাত্রীর ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল পুরো ফেরি।
পদ্মা-যমুনা পারাপারে ভোগান্তি না হলেও ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে পড়তে হচ্ছে সীমাহীন ভোগান্তিতে। মহাসড়কে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন। যে কারণে রিকশা, অটোরিকশা, সিএনজি এবং ট্রাক-পিকআপ এবং প্রাইভেটকারে করে গন্তব্যে ছুটছে এসব কর্মমুখী মানুষ।
বাস চলাচল বন্ধ থাকায় নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে নিরূপায় হয়ে গন্তব্যে ছুটছে কর্মমুখী মানুষ। ফেরিঘাট এলাকায় নেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন তৎপরতাও। স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নেই কর্মমুখী মানুষের মাঝে। গন্তব্যে যাওয়ার লড়াইয়ে ব্যস্ত ফেরিঘাট এলাকায় আগত হাজার হাজার যাত্রী।
ফেরিঘাট এলাকার তিন নম্বর পন্টুনে আলাপ হয় গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক সাহিদা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পারলাম রোববার থেকে অফিস খোলা। পরে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গাজীপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেছি। তবে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় সীমাহীন ভোগান্তি হচ্ছে।
গাবতলীমুখী যাত্রী আমিন উদ্দিন বলেন, পাটুরিয়া ফেরিঘাট থেকে গাবতলীর ভাড়া ১০০ টাকা। প্রাইভেটকারে সেই ভাড়া নিচ্ছে দেড় হাজার টাকা। চাকরি রক্ষার তাগিদে বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আফরোজা খানম নামের এক পোশাকশ্রমিক বলেন, ৫ তারিখ পর্যন্ত লকডাউন থাকায় গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে ছিলাম। কারখানা খুলে দেয়ায় এখন গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা হয়েছি। সড়ক-মহাসড়কে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় কখনও রিকশা-ভ্যান, আবার কখনও পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যাত্রা বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রাইভেটকার চালক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ গাড়ির চাকা। পরিবার-পরিজন নিয়ে হতাশা। করোনা সংক্রামণ ঝুঁকি থাকলেও পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে প্রাইভেট কার নিয়ে রাস্তায় নেমেছি।
অতিরিক্ত ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাস্তাঘাটে সব কিছু ম্যানেজ করে চলতে হয়। সেখানে খরচ আছে। কাজেই বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়া নিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্পোরেশন (বিআেইডব্লিউটিসি) আরিচা ঘাটের ডিজিএম জিল্লুর রহমান বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ছোট-বড় মিলে আটটি এবং আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে তিনটি ফেরি চলাচল করছে। প্রতিটি ফেরিতে হাজারও যাত্রী পারাপার হচ্ছে।
সরেজমিনে সাইনবোর্ড এলাকায় দেখা যায়, বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ এসে জড়ো হয়েছেন। গণপরিহন বন্ধ থাকায় তারা ছোট ছোট যানে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।
সাইনবোর্ডের মতো একই অবস্থা দৌলতদিয়ায়। প্রতিটি ফেরিতে যাত্রীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত। ফেরি পারাপারের সময় স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব দেখা যায়নি।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেও যাত্রীদের ভিড় দেখা গেছে। মাওনা চৌরাস্তায় কথা হয় নারী শ্রমিক রেহেনা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, ছোট সন্তানকে কোলে নিয়ে ভোর ৬টায় ময়মনসিংহ থেকে রওনা হয়েছেন টঙ্গীর উদ্দেশে। ৬০ কিলোমিটার সড়ক পার হতে অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশায় আসতে হয়েছে। এতে তাকে ৭০০ টাকা খরচ গুনতে হয়েছে। বাকী ৪০ কিলোমিটার পথ তাকে অতিরিক্ত ভাড়ায় চলতে হবে।
অপর শ্রমিক আমিনুল ইসলাম জানান, মহাসড়কে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঈদের ছুটির পর কারখানা খুলে দেওয়ায় তাদের বিপদে পড়তে হয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়ায় ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।
ঢাকামুখী প্রায় সব যাত্রী জানিয়েছেন, আগামীকাল থেকে তাদের কারখানা খুলছে। এ জন্য ভোগান্তি সত্বেও ঢাকায় আসছেন। দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় ভেঙে ভেঙে আসতে হচ্ছে তাদের। একইসঙ্গে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে।
শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণায় শনিবার সকাল থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক হয়ে ঢাকার দিকে ছুটছে অসংখ্য শ্রমিক। এদিকে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ভাড়া নৈরাজ্যসহ পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা।
গণপরিবহন না থাকায় খোলা ট্রাক, পিকআপ, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় কয়েক গুণ ভাড়া বেশি দিয়ে গাদাগাদি করে ফিরতে হচ্ছে। অনেককে গাড়ি না পেয়ে হেঁটেই রওনা দিতে দেখা গেছে।
এলেঙ্গায় কথা হয় পোশাক শ্রমিক ফারজানা, রফিকুল ইসলাম ও মাসুদসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানান, ভোর রাতে রওনা দিয়ে কয়েক দফায় ভেঙে ভেঙে নানা পরিবহন ও পায়ে হেঁটে এলেঙ্গা পর্যন্ত এসেছেন। এখন আবার অন্য পরিবহনে উঠে ঢাকায় ফিরতে হবে। গাড়ি না পেলে পায়ে হেঁটেই কর্মস্থলে ফিরতে হবে।
তারা আরও জানান, চাকরি বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরতে হচ্ছে। সরকার যদি পোশাক শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করে বাস চালু করে দিতো, তাহলে এমন ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। পশু পরিবহনের চেয়েও গাদাগাদি করে কর্মস্থলে ফিরতে হচ্ছে।
এদিকে ভোগান্তির মধ্যে বৃষ্টির কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন তারা। বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে ফিরছেন। স্বাস্থ্যবিধিসহ ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে প্রশাসনের তেমন একটা নজরদারি চোখে পড়েনি।
বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, গার্মেন্টস খুলে দেওয়ার খবরে কিছু কিছু মানুষ ঢাকায় ফিরছে। মাইক্রোবাস, পণ্যবাহী ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করছে। তবে গণপরিবহন চলছে না। দুই-একটি বাস সড়কে দেখা গেলেও ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।