
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যানের সরকারি বাসভবন সংস্কারকাজে ভয়াবহ অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারের প্রমাণ পেয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। মাত্র ৩০ লাখ টাকায় সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল যে সংস্কারকাজ, সেটি শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ১৬ লাখ টাকায়—প্রায় সাত গুণ বেশি ব্যয়!

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, দরপত্র আহ্বানের আগেই ৮০ শতাংশ কাজ শেষ করে ফেলা হয়েছিল বাংলোটির। অথচ রাজউকের নিজস্ব তদন্তে “কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়নি” বলে দায়সারা প্রতিবেদন দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজউকের সেই তদন্ত ছিল “লোকদেখানো ও স্বার্থরক্ষার প্রচেষ্টা”।
প্রাক্কলন ৩০ লাখ, ব্যয় ২ কোটি ১৬ লাখ : গুলশান ৬ নম্বর সড়কের ১ নম্বর প্লটে অবস্থিত রাজউক চেয়ারম্যানের সরকারি বাসভবনটি সংস্কারের জন্য শুরুতে প্রাক্কলন করা হয় মাত্র ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু কাজ শেষে বিল দাঁড়ায় দুই কোটি ১৬ লাখ টাকা।

গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্তে জানা গেছে, দরপত্র ছাড়াই মার্চ ২০২৪-এ কাজ শুরু হয়, পরে নামকাওয়াস্তে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। তাতে মেসার্স নিয়াজ ট্রেডার্স নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাগজে-কলমে কাজ দেওয়া হয়।

রাজউক বলল ‘সব ঠিক’, মন্ত্রণালয় বলল ‘ভয়াবহ অনিয়ম’ : সংস্কারকাজ নিয়ে অভিযোগ উঠলে রাজউক গত মে মাসে তদন্তে নামে। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে তারা জানায়—“কাজে কোনো অনিয়ম হয়নি।” কিন্তু পরে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নিজস্ব তদন্তে বিপরীত চিত্র দেখতে পায়।
দুই সদস্যের কমিটি ২৭ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। তাতে বলা হয়, দরপত্রের আগেই কাজ শুরু, প্রাক্কলন অনুমোদনে সরকারি বিধি ভঙ্গ এবং কাজের আর্থিক হিসাব ‘অযৌক্তিক’।
কমিটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে—এই অনিয়মের সঙ্গে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান (অব.), প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদ এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাহাত মুসলেমীন জড়িত ছিলেন।
তবে সাবেক চেয়ারম্যান ছিদ্দিকুর রহমান গত ২৪ অক্টোবর মারা যান।
নকশা উপেক্ষা, মৌখিক নির্দেশে কাজ শুরু : তদন্তে উঠে এসেছে, গত বছর রাজউক প্রকৌশল বিভাগ ‘চেয়ারম্যান বাংলো’ সংস্কারের প্রাক্কলন করে ৩০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প ভবনটিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করে নতুন ভবন নির্মাণের সুপারিশ দেয়।
কিন্তু সেই সুপারিশ পাশ কাটিয়ে প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদ ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাহাত মুসলেমীন মৌখিক নির্দেশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই)-কে কাজ শুরু করতে বলেন।
দরপত্র, নকশা, অনুমোদন—কিছুই ছাড়াই শুরু হয় নির্মাণ।
চাপ, প্রতিরোধ ও ‘চিঠি প্রত্যাহার’ : এই অনিয়মে বাধা দেন তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কাইছার। তিনি লিখিতভাবে কমিটির আহ্বায়ককে কাজের বিস্তারিত পরিকল্পনা, নকশা ও অনুমোদনের কপি চেয়ে চিঠি দেন।
তবে তৎকালীন চেয়ারম্যান ছিদ্দিকুর রহমানের চাপে তিনি সেই চিঠি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। পরে চেয়ারম্যান নিজে দুই কোটি ৮৫ লাখ টাকার প্রাক্কলন অনুমোদনের জন্য চাপ দেন প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিককে। উজ্জ্বল মল্লিক সই না করায় ব্যাপারটি ফাঁস হয়ে যায়।
তখন তড়িঘড়ি করে প্রাক্কলন কমিয়ে ২ কোটি ১৬ লাখ টাকায় দরপত্র অনুমোদন করা হয়—তাও কাজের ৮০ শতাংশ শেষ হওয়ার পর!
তদন্তের পরও দায়ীদের ‘বাঁচানোর কৌশল’ : গণপূর্তের তদন্ত প্রতিবেদনে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ও পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় শুধু “কাজের গুণগতমান যাচাই” ও “ঠিকাদারকে পাওনা পরিশোধ” সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে।
রাজউকও একইভাবে দায়সারা পদক্ষেপ নেয়। শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়ে দায় সারেন রাজউক কর্তৃপক্ষ।
রাজউকের সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) ড. মো. আলম মোস্তফা বলেন, “গণপূর্তের তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে এখন পর্যন্ত কোনো চিঠি বা নির্দেশনা পাইনি।”
অন্যদিকে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক যুগ্ম সচিব জহিরুল ইসলাম খান বলেন, “আমরা প্রমাণের ভিত্তিতেই প্রতিবেদন দিয়েছি। সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব মন্ত্রণালয় ও রাজউকের।”
তবে মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
দায়হীনতার চক্রে নিমজ্জিত রাজউক : রাজউকের মতো একটি সংস্থায় এমন প্রকাশ্য অনিয়ম—যেখানে দরপত্রের আগেই কাজ শেষ, প্রাক্কলন সাত গুণ বাড়ানো—প্রমাণ করে প্রতিষ্ঠানটি জবাবদিহির সংকটে নিমজ্জিত।
গণপূর্তের তদন্তে সব অনিয়ম ধরা পড়লেও, বাস্তব পদক্ষেপের অভাব এই বার্তা দেয়— দোষীদের রক্ষায় এখনো প্রশাসনিক প্রভাব কাজ করছে।
শেষ কথা : ৩০ লাখ টাকার কাজ দুই কোটিতে গিয়ে ঠেকা, দরপত্রের আগে ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হওয়া, আর তদন্তের নামে দায়সারা আচরণ—সব মিলিয়ে রাজউক চেয়ারম্যান বাংলোর এই ঘটনা এখন সরকারি নির্মাণ খাতে স্বেচ্ছাচার ও দুর্নীতির প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
