
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মনিরুল ইসলাম।

নিজস্ব প্রতিবেদক : গণপূর্ত অধিদপ্তর—যে প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো উন্নয়নের মূল ভরকেন্দ্র, সেই দপ্তরকেই কি দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ করেছে এক অদৃশ্য টেন্ডার সাম্রাজ্য? তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মনিরুল ইসলামকে ঘিরে ওঠা অভিযোগগুলো এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো গুঞ্জন নয়—বরং তা পরিণত হয়েছে প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
অভিযোগকারীদের ভাষায়, এটি কেবল একজন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত অনিয়মের গল্প নয়—এটি ক্ষমতার ছায়ায় গড়ে ওঠা এক সিন্ডিকেট, কমিশন সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের অন্ধকার অধ্যায়।

এক বদলি আদেশেই কেন কেঁপে উঠল অধিদপ্তর ? সব বিতর্কের সূচনা হয় ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি বদলি আদেশকে ঘিরে। ওই আদেশে মো. মনিরুল ইসলামকে ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল–১–এ পুনরায় দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বদলি আদেশ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই অধিদপ্তরের ভেতরে ভেসে ওঠে প্রশ্ন : “টেন্ডার সিন্ডিকেট কি আবার সক্রিয় হতে যাচ্ছে?” একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, “যেখানে নিয়ম ভাঙলে তদন্ত হওয়ার কথা, সেখানে এমন বদলি অনেকের চোখে পুরস্কারের মতো।”
এই বদলি আদেশই নতুন করে উসকে দেয় পুরনো অভিযোগের আগুন।
১৬ বছরের ‘নেটওয়ার্ক’—যেখানেই যান, অভিযোগ পিছু ছাড়ে না : চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি কিংবা ঢাকা—মনিরুল ইসলামের কর্মস্থল বদলালেও অভিযোগের ধরন নাকি একই থেকেছে।
অভিযোগকারীদের দাবি— তিনি দীর্ঘ ১৬ বছরে একটি শক্তিশালী ঠিকাদারি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন, যা বিভাগ বদলালেও কার্যত অক্ষত থেকেছে। বারবার উঠে আসা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম— গ্যালাক্সী অ্যাসোসিয়েটস, ডেল্টা কনস্ট্রাকশন এবং ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি বেনামে কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন বা কাজ ভাগ করে দিতেন। চট্টগ্রাম সার্কেলের এক কর্মকর্তা বলেন— “ওই সময় কমিশন বাণিজ্য ছিল ওপেন সিক্রেট। সবাই জানত, কিন্তু বলার সাহস পেত না।”
ঢাকায় এসে ‘OTM সিন্ডিকেট’—নতুন বিতর্কের বিস্ফোরণ : ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ঢাকার তিনটি বিভাগের নথি বিশ্লেষণে উঠে এসেছে বিস্ময়কর তথ্য। বিভাগ–১: প্রায় ৭০% টেন্ডার OTM পদ্ধতিতে, বিভাগ–২ ও নগর বিভাগ: ৮০%–এর বেশি টেন্ডার OTM, অভিযোগকারীদের ভাষ্য—“OTM ছিল নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের সুবিধা করে দেওয়ার কৌশল। এখানেই নিয়মিত কমিশনের প্রবাহ চলত।” এই অস্বাভাবিক প্রবণতাই তৈরি করেছে তথাকথিত ‘OTM সিন্ডিকেট’ নিয়ে তীব্র আলোচনা।
যেসব টেন্ডার আইডি ঘিরে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন : তদন্তকারীদের নজরে এসেছে একাধিক টেন্ডার আইডি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—1102004, 1091460–1091462, 1091815–1091819, 1089451–1089464, 1112907–1112912, 1116603, 1116615, 1116829, 1116866, 1116872, 1114051, 1062648–1062654, 1056143–1056147, 1069899, 1071271, 1071766, 1069900, 1068865–1068870, 1057813 সহ আরও বহু টেন্ডার। কর্মকর্তাদের দাবি— “এসব টেন্ডারে গড়ে ৫ শতাংশ কমিশন নেওয়া হয়েছে, যা মিলিয়ে দাঁড়ায় কয়েক কোটি টাকা।”
‘উচ্চপর্যায়ের আস্থা’—সবচেয়ে স্পর্শকাতর অভিযোগ : অভ্যন্তরীণ সূত্রের দাবি, মনিরুল ইসলামের প্রশাসনিক টিকে থাকার পেছনে রয়েছে ‘উচ্চপর্যায়ের আস্থা’—এই ধারণাই কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হতাশা তৈরি করেছে।
একজন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন— “একই নিয়ম ভাঙলে কারও বিরুদ্ধে তদন্ত, আর অন্যজনের পদোন্নতি—এটাই এখনকার বাস্তবতা।”
বদলি–বাণিজ্যের অভিযোগও সামনে : অভিযোগের তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরও একটি গুরুতর বিষয়— সুবিধাজনক স্থানে নির্বাহী প্রকৌশলীদের বদলি করিয়ে দিতে প্রভাব খাটানো এবং এর বিনিময়ে আর্থিক লেনদেন। কয়েকজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, এই প্রক্রিয়াও ছিল একটি লাভজনক অদৃশ্য চ্যানেল।
সম্পদের পাহাড়—আয়ের সঙ্গে কি সামঞ্জস্যপূর্ণ ? নথি ও কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, মনিরুল ইসলামের নামে বা সংশ্লিষ্টদের নামে যেসব সম্পদের হিসাব আলোচনায় এসেছে—ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরে ১০ কাঠা জমিতে ৮ তলা ভবন, খুলনায় আলিশান বাড়ি, খুলনার ডুমুরিয়ায় ৫ একর জমি এবং কক্সবাজারে একটি হোটেল।
এক জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীর মন্তব্য—“অধিদপ্তরের ভেতর সবাই দেখেছে, কীভাবে এক সময়ের তৃতীয় সারির কর্মকর্তা অল্প সময়েই বিরাট সম্পদের মালিক হয়েছেন।”
শেষ কথা : এই প্রতিবেদনভুক্ত কোনো অভিযোগই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতে প্রমাণিত নয়। তবে একটি বদলি আদেশকে কেন্দ্র করে যেভাবে পুরনো ও নতুন অভিযোগ একসঙ্গে সামনে এসেছে, তাতে অধিদপ্তরের ভেতরেই প্রশ্ন উঠেছে— “এখনই যদি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত না হয়, তাহলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ভবিষ্যৎ কি আরও অন্ধকারে ঢুকে পড়বে?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে এখন পুরো প্রশাসন—আর তাকিয়ে আছে সাধারণ মানুষও।
