নিজস্ব প্রতিবেদক : তৈরি পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে গর্ব বাংলাদেশের তাতে বাগড়া লাগাচ্ছে বিশ^জুড়ে মহামারি হিসেবে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস। বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের অন্যতম ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে বৃহৎ অর্থনীতির ক্রেতা দেশগুলো এখন প্রাণঘাতী ভাইরাসটির বিরুদ্ধে মরণপণ লড়ছে। এমন অবস্থায় ক্রেতারা বাতিল করছেন ক্রয়াদেশ। সবশেষ বুধবার পর্যন্ত দুই কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। তাই দুশ্চিন্তা ভর করেছে গার্মেন্টশিল্প মালিকদের কপালে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) বলছে, এমনিতেই তৈরি পোশাকশিল্পে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি চলছে। তার ওপর করোনার প্রভাবে পোশাকখাতে দেখা দিয়েছে আরও সংকট। কাচামাল সংকটের সঙ্গে নতুন করে এখন যোগ হয়েছে ক্রেতাদের ক্রয় আদেশ স্থগিত করে দেয়া। এমন যদি চলতে থাকে তাহলে কর্মীদের বেতন দেয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে তাদের জন্য।
বিজিএমইএ নেতারা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে কাঁচামাল আমদানি সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এখন নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিচ্ছে রপ্তানিতেও। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে মহাসংকটে পড়বে পোশাকশিল্প।
বিজিএমইএর সভাপতি করোনার কারণে পোশাকশিল্প ‘ভয়াবহ সময়’ পার করছে মন্তব্য করে বলেন, আমাদের বায়াররা যদি অর্ডার দেয়া পোশাক শিফট করতে না দেন তাহলে আমরা সাংঘাতিক রকমের বিপদগ্রস্তের অবস্থায় চলে যাব।
বিজিএমইএ তথ্যমতে পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রেতারা অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় চাহিদা কমে বিক্রি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশ দিচ্ছেন ক্রেতারা। এ প্রেক্ষাপটে বিরূপ পরিস্থিতিতে ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ বাতিলের তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে বিজিএমইএ। ইতোমধ্যেই বিজিএমইএর সদস্য ২০ প্রতিষ্ঠানের এক কোটি ৭২ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। স্থগিত হয়েছে ১৩ লাখ ৩৮ হাজার ডলারের ক্রয়াদেশ।
রুবানা হক এ বিষয়ে বলেন, ক্রেতাদের বিবেক কোথায়? আমাদের চাপ প্রয়োগ করার সময় তারা অন্য কিছু চিন্তা না করে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অবহেলা হচ্ছে অভিযোগ করেন। কিন্তু এখন যখন এ রকম একটা বৈশ্বিক বিপর্যয় ঘটছে, এ সময়ে এসে তারা শুধু ব্যবসার কথা ভাববেন আর মানুষের কথা ভুলে যাবেন, এটা তো হয় না।
ক্রেতাদের চিন্তা মুনাফার আর দেশের পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের চিন্তা বাঁচার- এই বাস্তবতা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা এখন কোথায় দাঁড়াব? আমাদের এত কর্মী, সামনে ঈদ আছে, বোনাস আছে। এভাবে যদি কার্যাদেশ বাতিল হতে থাকে, তাহলে কী হবে?
‘ক্রেতারা যখন বলে আপনারা কাপড় কাটবেন না, তখন ওই কাপড়ের আর কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। এ কাপড় কবে নেবে কিছুই জানি না আমরা। এসব কাপড়ের বিপরীতে ক্রয়াদেশ দেয়ার কথা এপিল-মে মাসে। কিন্তু ক্রেতারা এখন কোনোটাই প্লেস করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, রপ্তানি অনেক কমে যাবে।
চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ সব বৃহৎ অর্থনীতির দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির বড় অংশই যায় ইউরোপে। ইতালি, জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে এরই মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারির রূপ নিয়েছে। অনেক জায়গাতেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দোকান। কমেছে স্থানীয় কিংবা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের পরিসর। বেশি আক্রান্ত স্থানগুলোতে বিভিন্ন ব্র্যান্ড নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গুটিয়ে নিয়েছে তাদের আউটলেট।
বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেন, যখন করোনাভাইরাসের বিপদটা শুরু হলো তখন আমরা সরবরাহ ধরে রাখতে কাঁচামাল নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। এখন যেটা হচ্ছে বেশিরভাগ ক্রেতারা আমাদের বলছেন কাপড়গুলো না কাটতে। আর যদি কাটা হয়ে যায় তাহলে যেন সেলাই করা না হয়। আর সেলাই হয়ে গেলে যেন সিফট না করা হয়।
তিনি বলেন, আমাদের প্রশ্ন হলো এখনো কিন্তু ক্রেতারা ডাবল ডিজিটে প্রফিট করেন। তাদের মুনাফা ছাড়া ক্ষতি হয় না। কিন্তু উনারা যদি আমাদের অর্ডারগুলো না নেয়, হোল্ড করতে বলেন তাহলে আমাদের শ্রমিকদের বেতন বোনাস দেয়া, আমাদের ব্যাক টু ব্যাক এলসি দেয়া সব আটকে যাবে। প্রচ- একটা ক্যাশ ফ্লো ক্রাইসিসে (আর্থিক সংকটে) পড়ব। কাজেই ভয়াবহ সময় যাচ্ছে আমাদের।
করোনাভাইরাসের চাপে পড়ে মিয়ানমার, কম্বোডিয়া শ্রমিক ছাঁটাই করছে উল্লেখ করে রুবানা বলেন, ‘আমরা কিন্তু ওয়ার্কার ছাঁটাই করব না। কারণ আমার শ্রমিক আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে আমরা বায়ারদের বলেছি দয়া করে কোনো অর্ডার বাতিল করবেন না। পরে আপনারা ইনভেন্টরি অ্যাডজাস্ট করেন। এরপরও তারা যদি বাতিল বা স্থগিত করা অব্যাহত রাখে আমরা সাংঘাতিক রকমের বিপদে পড়ে যাব।
বিজিএমইএর তথ্যমতে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো নিট ও ওভেন দুই ধরনের পোশাক তৈরি করে। বিশ^জুড়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে মূলত ওভেন পোশাকের কারখানাগুলোই বেশি বিপাকে পড়ছে। তুলনায় নিট পোশাকের কারখানাগুলোতে করোনার প্রভাব তুলনামূলকভাবে এখনো কম।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে তৈরি পোশাক খাত থেকে আয় হয়েছে দুই হাজার ১৮৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে পাঁচ দশমিক পাঁচ-তিন ভাগ কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ তিন হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। যা মোট রপ্তানির ৮০ ভাগেরও বেশি। এই খাতে কোনো সংকট তৈরি হলে তার প্রভাব পড়বে তাই গোটা রপ্তানি বাণিজ্যে।


