
নিজস্ব প্রতিবেদক (নোয়াখালী) : বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রায় এক কোটি মানুষ আজও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। দেশের অন্যান্য জেলায় যেখানে আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চালু হয়েছে, সেখানে নোয়াখালী মেডিকেল কলেজের ৫০০ শয্যার হাসপাতাল এখনো কাগজে বন্দি। প্রধান বাধা — সাবেক আওয়ামী এমপি মামুনুর রশীদ কিরনের লাঠিয়াল ও গুন্ডাবাহিনীর দখলদারি।

দখলদার কিরণ বাহিনীর দাপটে থেমে আছে উন্নয়ন : স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মেডিকেল কলেজের জন্য ২০০৮ সালে বেগমগঞ্জ উপজেলার মিরওয়ারিশপুর ইউনিয়নে ২৬ দশমিক ৫৩ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালে চারপাশে বাউন্ডারি দেয়াল নির্মাণ করা হয়। সে সময় বেগমগঞ্জে প্রভাব বিস্তার করার জন্য সাবেক এমপি মামুনুর রশীদ কিরণ তৈরি করেছিলো ৫০/৬০ জনের এক ভয়ংকর লাঠিয়াল বাহিনী। এ বাহিনীর সদস্যদের তিনি নোয়াখালীর বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। মেঘনার দূর্গম চরাঞ্চলের জলদস্যু বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে তিনি এ বাহিনী গঠন করেছিলেন। জমি দখল, বিরোধী মত দমন, রাজনৈতিক মিটিং মিছিল ইত্যাদির জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকতো তার এই লাঠিয়াল বাহিনী।
কিন্তু এতো লোকজন বেগমগঞ্জে রাখার জায়গা তার ছিলোনা। সে সময় কিরণ তার প্রভাব খাটিয়ে মেডিকেল কলেজের দেয়ালের অন্তত ৮–১০ জায়গা ভেঙে ফেলে এবনহ কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর পুকুরপাড় সংলগ্ন খালি জায়গায় রাতারাতি টিনসেড ঘর তুলে দিয়ে তার পালিত এই লাঠিয়াল বাহিনীর জন্য পরিবার সহ সাময়িক বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়। সরকার পরিবর্তনের পর ফ্যাসিবাদী আমলের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই কিরণ আত্মগোপনে চলে গেলেও তার দখলবাজ এই লাঠিয়াল বাহিনী এখনো কলেজের ভেতরে ঘাঁটি গেড়ে আছে। ভয়ে ও আতংকে কেউ কিছু বলতে পারছেনা। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় রয়েছে ফ্যাসিস্ট দোসর ১৫টি বাহিনী।

একসময়ের শান্ত জনপদ বেগমগঞ্জ উপজেলার এই অবস্থার জন্য এই লাঠিয়াল বাহিনী দায়ী বলে মনে করছেন এলাকাবাসী ও নাগরিক সমাজ। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নোয়াখালী জেলা কমিটির সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোল্লা হাবিবুর রাছুল মামুন বলেন, সন্ত্রাসী এই ১৫টি বাহিনীগুলো কিরনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠেছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর এরা নিজ বাড়িতে না থেকে মেডিকেল কলেজ এ কিরণের লাঠিয়াল বাহিনীর সংগে ভেতরেই অবস্থান করছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের লোকজন এদেরকে দিয়ে বৃহত্তর নোয়াখালীর ৩ জেলায় বিভিন্ন অপকর্ম ঘটিয়ে অর্ন্তবর্তী সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে।

২০১৮ সালের মে মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় , ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ৫০০ বেডেড হাসপাতাল ও এনসিলারি ভবন ইন পাবনা, যশোর, কক্সবাজার ও নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ ও ৫০০ বেড আধুনিক হাসপাতাল, নোয়াখালী’ অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের অনুমোদিত প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা কিন্তু বিগত ৭ বছরে অর্থাৎ জুন ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ এর অবকাঠামোগত অগ্রগতি ছিলো প্রায় শূন্য। সম্প্রতি কলেজ কর্তৃপক্ষ জায়গা খালি করতে বললে তারা লাঠিসোটা হাতে তেড়ে আসে এবং প্রশাসনের নির্দেশ অমান্য করে প্রকাশ্য সংঘাতের হুমকি দেয়। নোয়াখালীবাসীর দাবি—অবিলম্বে অভিযান চালিয়ে কিরণ বাহিনীর দখলদারিত্ব উচ্ছেদ করে হাসপাতাল নির্মাণ শুরু করতে হবে।
মীরওয়ারিশপুর ইউনিয়নের নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ এর পুকুর পাড় সংলগ্ন অবৈধভাবে থাকা এই লাঠিয়াল বাহিনীর মূলহোতা বর্তমানে জাকির বাহিনীর প্রধান জাকির। কিরণের লাঠিয়াল বাহিনী অনেকের কাছে জাকির বাহিনী নামে পরিচিত। পার্শ্ববর্তী সোনাইমুড়ী উপজেলার হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির মামলার আসামি জাকির হোসেন। নোয়াখালীর একটি আদালতে ৪ বছর আগে অস্ত্র মামলায় ১০ বছরের সাজা হলেও জাকিরকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
বেগমগঞ্জের প্রধান দুই বাহিনীর একটি এই সুমন বাহিনীর প্রধান সুমন ওরফে খালাসি সুমন ৩৬ মামলার আসামি। আরেক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছে ৩৮ মামলার আসামি সম্রাট বাহিনীর প্রধান সম্রাট। এরা দুজনেই জাকিরের ছায়ায় মেডিকেল কলেজের ওই জায়গায় গা ঢাকা দিউএ রয়েছে।
এছাড়া সম্রাট বাহিনী ও সুমন বাহিনীর প্রধান ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুজনই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হন। দলীয় কোনো পদ-পদবি না থাকলেও সম্রাট ও সুমন এলাকায় যুবলীগের নেতা হিসেবেই পরিচিত। কিরনের প্রশ্রয়ে তাঁদের দাপট বেড়েছে বলে এলাকাবাসী ও দলীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে। দুই বাহিনীর সদস্যদের বাড়ি হাজিপুর হলেও ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর এরা নিজ বাড়িতে না থেকে মেডিকেল কলেজে কিরণের লাঠিয়াল বাহিনীর সংগে ভেতরেই অবস্থান করে চৌমুহনী পৌর এলাকা ও হাজীপুরের আশপাশের একাধিক ইউনিয়নে সক্রিয় রয়েছে।
এক যুগের স্থবিরতা : উন্নয়ন ঠেকিয়ে রেখেছে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি তত্বাবধায়ক সরকার আমলে নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হলেও গত ১৬ বছরেও নিজস্ব হাসপাতাল পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। হাসপাতালের বিষয় জানতে চাইলে নোয়াখালী মেডিক্যাল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা: আমিনুর রহমান বলেন, “২০০৮ সালে দেশের মেডিকেল কলেজের অনুমোদেনের সাথে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌরাস্তার পার্শ্বেই মিরওয়ারিশপুর ইউনিয়নে ২৬ দশমিক ৫৩ একর জায়গায় নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। ২০০৮ সালের অক্টোবরে ১ম ব্যাচের শিক্ষার্থী ভর্তির মধ্য দিয়ে এ কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে শেষ হয় একাডেমিক ভবন নির্মান। ৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ছাত্র এবং একটি ছাত্রী হোষ্টেল নির্মান করা হয়।” কিন্তু এখনো হয়নি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ফলে মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি উন্নত চিকিৎসা সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ৮০ লক্ষাধিক মানুষ।
শিক্ষার্থী ও জনস্বাস্থ্যে ভয়াবহ প্রভাব : এক যুগের এই বিলম্বে স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা শিক্ষা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত— নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুরের ১ কোটিরও বেশি মানুষ বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য ঢাকা-চট্টগ্রামের ওপর নির্ভরশীল। রোগীরা ৩০-৪০% বেশি খরচে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এখানে হাসপাতাল নির্মিত না হওয়ায় মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের নোয়াখালী ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে প্রাক্টিক্যাল করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ১০ কিলোমিটার দূরের নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে প্র্যাকটিক্যাল করতে হয়। স্থানীয় অর্থনীতি ও উৎপাদনশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, হাসপাতালটি চালু হলে বছরে ৫০,০০০ রোগী সরাসরি চিকিৎসাসেবা পাবে এবং ১,০০০ জনের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি — চার দশকের প্রতারণা
নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্পটি আসলে চার দশকের ব্যর্থ প্রতিশ্রুতির প্রতীক। ১৯৮০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জেলা শহর মাইজদী জেনারেল হাসপাতাল সড়কের পাশে মধুপুর মৌজায় নোয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জন্য সরকার ভূমিও অধিগ্রহণ করে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্ষমতায় এসে নোয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালের পুরো প্রজেক্ট বাতিল করে দেন। মাইজদী মধুপুর হীরামন কুঠিরে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পাথরটি এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। ২০০৮ সালে পুনরায় উদ্যোগ নেয়া হলেও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী কিরণ ও তার এই লাঠিয়াল বাহিনী দৌরাত্ম্যে এখনো মেডিকেল কলেজের কাজ শুরু করা যাচ্ছেনা।
নোয়াখালীবাসীর ক্ষোভ ও দাবি : নোয়াখালীবাসীর একটাই দাবি “কিরণের গুন্ডাবাহিনীকে উচ্ছেদ করুন, আমাদের হাসপাতাল দিন!” স্থানীয় নাগরিকদের ভাষায়, “যদি যথাসময়ে হাসপাতালটি তৈরি হতো, করোনা মহামারির সময় হাজারো প্রাণ রক্ষা করা যেত।” রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “নোয়াখালীর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্প দলীয় প্রভাব, দখলবাজি ও প্রশাসনিক অদক্ষতার এক জীবন্ত উদাহরণ।”
অবিলম্বে উচ্ছেদ অভিযান ও নির্মাণ শুরু এখন সময়ের দাবি :
নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শুধু একটি ভবন নয় এটি বৃহত্তর নোয়াখালীর অধিকার, মর্যাদা ও চিকিৎসা নিরাপত্তার প্রতীক। জনগণের আহ্বান কিরণ বাহিনীর দখলমুক্ত করতে অবিলম্বে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করুন। ৫০০ শয্যার হাসপাতালের নির্মাণকাজ দ্রুত শুরু করুন। আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, টেলিমেডিসিন ও ক্যান্সার ইউনিট চালু করুন।
এক যুগের অপেক্ষা শেষ হোক। নোয়াখালী চায় হাসপাতাল, চায় ন্যায়। লাঠিয়াল বাহিনীর রাজনীতি নয়, এখন সময় উন্নয়নের।
