
নিজস্ব প্রতিবেদক : জুলাই গণহত্যায় সরাসরি সম্পৃক্ত, হত্যা মামলার আসামি হয়েও কীভাবে পুরস্কারস্বরূপ বদলি পান একজন সরকারি কর্মকর্তা? প্রশ্নটি এখন সর্বত্র। ২০২৪ সালের জুলাই গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে যাঁর বিরুদ্ধে মামলা, মানববন্ধন ও ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হয়েছে—সেই শহীদুল আলমকেই আবারো গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসানো হয়েছে।

পল্টন থানার মামলা নম্বর ৮৭৮–এর এজাহারভুক্ত আসামি শহীদুল আলম বর্তমানে গণপূর্ত অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য উইংয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। গত ৪ ডিসেম্বর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন (স্মারক: ২৫.০০.০০০০.১৩০.১২.০০১.২০১১-১০৫) জারি করে তাঁকে প্রেষণ থেকে ফিরিয়ে এনে এই ‘প্রাইজ পোস্টিং’ দেওয়া হয়।

এর আগে, ১৮ নভেম্বর ২০২৪ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শহীদুল আলমের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেন সচেতন ছাত্র-জনতা। দৈনিক মানবকথাসহ একাধিক জাতীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তাঁর দুর্নীতি, অনিয়ম ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

জনচাপের মুখে একপর্যায়ে তাঁকে ‘অগুরুত্বপূর্ণ’ চেয়ারে সরাতে বাধ্য হলেও, মাত্র ৯ মাস ৮ দিনের ব্যবধানে আবার ঢাকার মধ্যেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আরও শক্ত অবস্থানে বসানো হয়েছে।

আওয়ামী লীগের মাস্ক পরা আমলা : আমলা না রাজনীতিবিদ—চেনার উপায় নেই ! মানববন্ধনের ছবিতে দেখা যায়, কালো মাস্ক পরা এক ব্যক্তি—যার মুখে আওয়ামী লীগের মনোগ্রাম ও নৌকা প্রতীক। প্রথম দর্শনে যে কাউকেই মনে হবে তিনি একজন রাজনীতিবিদ।
কিন্তু বাস্তবতা আরও ভয়াবহ—তিনি একজন সরকারি আমলা, তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সংস্থাপন ও সমন্বয়) শহীদুল আলম। ১৬ বছরের শাসনামলে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে দলীয় মাস্ক পরতে বাধ্য করার নজির নেই। তাহলে শহীদুল আলম কী প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন? উত্তর একটাই—তিনি নিশ্বাসে, বিশ্বাসে আওয়ামী লীগ ধারণ করেন।

বদলি, নিয়োগ ও বরাদ্দ—সবই ছিল টাকার খেলাঘর ও ২০০–৪০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ : অভিযোগ রয়েছে, বদলি, নিয়োগ, বাসা বরাদ্দ, থোক বরাদ্দ ও ফান্ড ছাড়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে শহীদুল আলম ২০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
ছাত্রলীগ ক্যাডারদের দিয়ে ঢাকাজুড়ে শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার অভিযোগ : ছাত্রলীগ ক্যাডারদের দিয়ে ঢাকাজুড়ে শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। তাঁর অনুমোদন ছাড়া ঢাকায় কোনো নির্বাহী প্রকৌশলীর টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শতভাগ ওটিএম (Over the Market), এপিপির বাইরে কাজ, বকেয়া সৃষ্টি—সবই হয়েছে তাঁর সরাসরি অনুমোদনে। রক্ষণাবেক্ষণ গণপূর্ত বিভাগে ২০২২–২৩ ও ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ১১৬টি কাজ ওটিএমের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়—যার প্রতিটির অনুমোদন দিয়েছেন শহীদুল আলম নিজে।
১৬৯ পদে নিয়োগ, ফল গায়েব, কোটি টাকার লেনদেন এবং সিলগালা খাম ‘হাওয়া’ হয়ে গেল কীভাবে ? ২০২৩ সালে ৬ ক্যাটাগরির ১৬৯টি পদে নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে যায়। নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন শহীদুল আলম নিজেই।
অভিযোগ রয়েছে, ১৫টি সিলগালা খামের একটি গায়েব করা হয় তাঁর হেফাজত থেকেই। বিষয়টি জানার পরও দেরিতে জিডি করা হয় এবং তদন্ত কার্যত ধামাচাপা দেওয়া হয়। এই নিয়োগ বাণিজ্যের পেছনে ৪০০ কোটি টাকার লেনদেন এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে টাকা পৌঁছে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
বিদেশ সফর, পাচার ও বিলাস : জনগণের করের টাকায় প্রমোদ ভ্রমণ : প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট না হয়েও শহীদুল আলম এক বছরে ৭ বার বিদেশ সফর করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব সফরের আড়ালে টাকা পাচার, দুবাইয়ে সম্পত্তি কেনা, সিঙ্গাপুরে কোটি টাকার চিকিৎসা ব্যয়—সবই দুর্নীতির অর্থে। প্রশ্ন থেকেই যায়।

জুলাই গণহত্যার আসামি কীভাবে বহাল তবিয়তে ? যদি তুলনামূলক ছোট অভিযোগে কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো যায়, তবে জুলাই গণহত্যার মামলার আসামি শহীদুল আলম কোন আইনে এখনো চাকরিতে বহাল? মাত্র ৯ মাসে তাঁর দায়মুক্তি কিসের বিনিময়ে ? নির্বাচনের আগে আবারো বড় নিয়োগ ও ‘স্বচ্ছতা’র নামে তামাশা কি পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে? জনস্বার্থে আমরা দাবি জানাচ্ছি— নির্বাচনের আগে সব নিয়োগ স্থগিত করা হোক এবং শহীদুল আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
