
নিজস্ব প্রতিবেদক : গণপূর্ত অধিদপ্তরের ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল (ই/এম) শাখায় এমন এক কর্মকর্তা বছরের পর বছর ধরে আছেন, যাকে সহকর্মীরা ব্যঙ্গাত্মকভাবে ডাকেন—“মালের খসরু”। নামটি এসেছে তার প্রকৃত নাম “মালিক খসরু”-র নামের সঙ্গে যোগ হয়ে, কিন্তু আরও বেশি এসেছে—অভিযোগের পাহাড় জমা হওয়া কর্মকাণ্ড থেকে।

অভিযোগ বলছে, সরকারি চাকরিতে থেকেও টাকার প্রতি তার এমন অস্বাভাবিক আকর্ষণ ও আগ্রাসী আচরণ দীর্ঘদিন ধরে পুরো অধিদপ্তরে এক ধরনের মৌন ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। ঢাকার ভেতরেই বছরজুড়ে লোভনীয় পোস্টিং—তার জন্যই নিয়ম যেন বাতিল। নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী মালিক খসরু অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ সময় ঢাকাতেই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিন বছরে বদলি—সরকারি নিয়ম,কিন্তু তার ক্ষেত্রে এই নিয়ম গত এক দশক প্রায় অকার্যকর।
৩, ৫ এবং সর্বশেষ ৭ নম্বর ডিভিশনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে সব সময় পেয়েছেন “লোভনীয়” দায়িত্ব : অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, তার এই অবস্থানের পেছনে আছে এক সাবেক প্রধান প্রকৌশলীর অদৃশ্য ‘আধ্যাত্মিক’ প্রভাব, যিনি খসরুকে নিজের “মুরীদ”-দের একজন হিসেবে দেখতেন।

এ নিয়ে অধিদপ্তরজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই কানাঘুষা—“গুরু-শিষ্যের ছায়াতেই খসরুর উত্থান।” আরও বিস্ময়কর তথ্য—পদোন্নতিও তিনি পেয়েছেন একই অফিস থেকে, যা প্রচলিত প্রশাসনিক বিধানের পরিপন্থী।

আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টার প্রকল্প—অনিয়মের বারুদভরা ঘর : আজিমপুর এলাকার বহুতল আবাসিক ভবন ও কার পার্কিং প্রকল্পে তিনি ছিলেন ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল কাজের তদারকির দায়িত্বে।অভিযোগকারীরা বলছেন, এখানেই অনিয়ম হয়েছে সর্বাধিক।
অভিযোগের সারমর্ম : ফাইল আটকে রেখে কমিশন আদায়, সাইট ভিজিট বা রিপোর্ট সাইনিংকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার, কাজের প্রতিটি ধাপে গড়ে ওঠা অঘোষিত “চেইন অফ কমিশন”। একাধিক ঠিকাদারের ভাষ্য— “টাকা ছাড়া তিনি কাগজে সাইন করেন না।” “কাজের বিল আটকে দিয়ে হোটেল আপ্যায়ন পর্যন্ত দাবি করেছেন।” “সাইটে গিয়ে নানা অজুহাতে হয়রানি ছিল নিয়মিত।”
অভিযোগ অনুযায়ী, শুধু আজিমপুরের বৃহৎ ইলেকট্রিক্যাল সাবস্টেশন প্রকল্পেই তার কমিশনের পরিমাণ অর্ধকোটি টাকার মতো হতে পারে।
নিম্নমানের যন্ত্রপাতি, প্রকল্পে ঝুঁকি—দীর্ঘমেয়াদে ব্যয় বাড়ছে : প্রকল্পে ব্যবহৃত সাবস্টেশন, জেনারেটর, সোলার প্যানেল, ফায়ার সেফটি ও অন্যান্য সরঞ্জামে নিম্নমানের পণ্য অনুমোদনের অভিযোগ এসেছে।
কিছু ঠিকাদারের দাবি— “তিনি কম দামের ব্র্যান্ড অনুমোদন করতেন—কারণ কমিশন বেশি ওঠে। ”ফলাফল হিসেবে আবাসিক ভবনগুলোতে দেখা দিচ্ছে –বারবার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা, ফায়ার সিস্টেমের ত্রুটি, যান্ত্রিক গোলযোগ, এগুলো শুধু বাসিন্দাদের ঝুঁকিতেই ফেলছে না—সরকারকে ভবিষ্যতে বাড়তি ব্যয়ও বহন করতে হতে পারে।
অভিযোগ : আত্মীয়স্বজনের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, কোটি টাকার সম্পদ : গোয়েন্দা সংস্থার একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে—মালিক খসরুর পরিবারের নানা সদস্যের নামে ২৫ টির বেশি ব্যাংক হিসাব চলছে।
এছাড়া অভিযোগ রয়েছে –খিলগাঁওয়ে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, টাঙ্গাইল মধুপুরে ২০ বিঘা জমি।
ঠিকাদারদের সঙ্গে যৌথ ডেভেলপার ব্যবসা ; নামে-বেনামে মোট সম্পদ ২০ কোটি টাকারও অধিক কিছু সূত্র বলছে—অর্থ পাচারের জন্য নিয়মিত হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠানো হয়, পরে দেশে এনে বৈধ উপার্জন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। নিজের অধিদপ্তরে নিজেই ঠিকাদার ?
ব্যবসায়িক স্বার্থের দ্বন্দ্বের অভিযোগ : অভিযোগ উঠেছে, তার পরিবারের নামে ব্রাদার্স ইলেকট্রিকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত, যেগুলো নাকি অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পে অংশগ্রহণ করত।
একজন সাবেক ঠিকাদারের বক্তব্য —-“কাজ না দিলে হুমকি, আর কাজ দিলে কমিশন না দিলে পেমেন্ট বন্ধ—এটাই ছিল নিয়ম।”
প্রকৌশলীদের একটি অংশ মনে করেন— “ঢাকায় স্থায়ীভাবে থাকা কিছু কর্মকর্তা গণপূর্তের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা—স্বচ্ছতার জায়গায় আঘাত করছেন বারবার।”
প্রশাসনের নীরবতা—প্রশ্নের পর প্রশ্ন : অধিদপ্তরের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্বীকার করেন—“অভিযোগ আছে, তবে লিখিত অভিযোগ না এলে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।” অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো দাবি করে—“অভিযোগ উঠলেই ‘উচ্চপর্যায়ের ফোন’ আসে। ফাইল সেখানেই থেমে যায়।”
এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে—একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন ? তার ব্যাংক হিসাব, বিদেশ ভ্রমণ ও লেনদেন—কখনো কি পর্যালোচনা করা হয়েছে?
শেষ কথা : আজিমপুর প্রকল্পের অনিয়ম শুধু একটি প্রকল্পের সমস্যা নয়—এটি দেখিয়ে দেয় প্রশাসনিক দুর্বলতা, প্রভাবশালীদের ছায়া এবং দুর্নীতিবিরোধী কাঠামোর সীমাবদ্ধতা। গণপূর্তের ভেতরে এখন প্রশ্ন—“স্বচ্ছতা কি সত্যিই সম্ভব, যদি এ ধরনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া না হয়?”
