
গণপূর্ত অধিদপ্তরের আলোচিত ও সমালোচিত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মানিক লাল দাস।

নিজস্ব প্রতিবেদক : গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মানিক লাল দাসকে ঘিরে যে বিস্ফোরক অভিযোগগুলো ওঠেছে—তা শুধু ব্যক্তিগত দুর্নীতির কাহিনি নয়, বরং পুরো গণপূর্ত অধিদপ্তরের গভীরে গেঁথে থাকা দুর্নীতির শিকড়ের এক নগ্ন প্রতিচ্ছবি। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে— এই প্রথম একজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে একযোগে চারটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা নড়েচড়ে বসেছে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) এবং আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটে জমা পড়া অভিযোগগুলো এতটাই বিস্ফোরক যে, মানিক লাল দাস অভিযোগের চারদিক ঘিরে থাকা চতুর্মুখী তদন্তের মুখোমুখি হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

অভিযোগের সারমর্ম : একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নাকি পরিণত হয়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের ‘অঘোষিত সম্রাটে’ : অভিযোগপত্র থেকে যে চিত্র পাওয়া যায়, তা রীতিমতো কঙ্কালসার এক রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির দালিলিক উপস্থাপন।

ক্ষমতার অপব্যবহার : ভুয়া ওটিএম দরপত্র অনুমতি, সিন্ডিকেট নির্ভর টেন্ডার বাণিজ্য, শত কোটি টাকার সন্দেহজনক সম্পদ, ছাত্র আন্দোলনে অর্থায়ন, বিদেশে অর্থ পাচার, আয়কর ফাঁকি এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায় বেপরোয়া দুর্নীতি।
অভিযোগকারীদের দাবি—মানিক লাল দাসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সম্পদ বিবরণী ও পরিবারের সদস্যদের সম্পদের তদন্ত হলে “দুর্নীতির জাল” স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
বরিশালে মানিক লাল দাসের ‘সিন্ডিকেট সাম্রাজ্য’—খান ট্রেডার্স থেকে রাতুল এন্টারপ্রাইজ : অভিযোগের ভাষ্য অনুযায়ী, বরিশাল গণপূর্ত সার্কেলকে তিনি একটি দুর্নীতির জল্লাদের চারণভূমিতে পরিণত করেছিলেন।
চারটি ফার্মকে নিয়ে তৈরি হয় তার “অপ্রতিরোধ্য সিন্ডিকেট”—খান ট্রেডার্স, খান বিল্ডার্স, রাতুল এন্টারপ্রাইজ এবং ইনভেন্ট পয়েন্ট কম্পিউটার।
এই সিন্ডিকেট ব্যবহার করে:,এলটিএম এর বদলে ওটিএম দরপত্র আদায়, ৮০% দরপত্রে সিন্ডিকেটের প্রবেশ, কোটি কোটি টাকা কমিশন বাণিজ্য, রাজনৈতিক ব্যবহারে অর্থ সরবরাহ।
অভিযোগে বলা হয়েছে— “বরিশাল–ভোলা–পটুয়াখালী–পিরোজপুর—গোটা দক্ষিণাঞ্চলকে স্রেফ নিজের ব্যবসায়িক লুঠের মাঠ বানিয়ে ফেলেছিলেন মানিক।”
রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতাচর্চা : হাসনাত–সাদিক পরিবারকে ব্যবহার ? অভিযোগকারীরা দাবি করেছেন—আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ক্ষমতাকালে প্রভাবশালী পরিবারের নাম ব্যবহার করে তিনি নাকি গোটা দক্ষিণাঞ্চলের গণপূর্ত কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করতেন।
অভিযোগে আরও রয়েছে—নির্বাচনে অর্থায়ন, ছাত্রলীগের মিছিলে লোক জোগান দিতে টাকার স্রোত, নির্বাহী প্রকৌশলীদের ওপর নির্দিষ্ট ফার্মকে কাজ দিতে চাপ, ডিসেম্বরের আগেই সিন্ডিকেটের নামে “মিনিমাম ৮টি করে কাজ” দেয়ার আল্টিমেটাম।
একে অনেকেই দেখছেন অফিসার–রাজনীতি–ঠিকাদার—এই তিন স্তম্ভের দুর্নীতির ত্রিমাত্রিক চক্রের নির্মাণ।
যশোর সার্কেলের ‘চুক্তিবাজির মহোৎসব’—উন্মুক্ত দরপত্রে পছন্দের ঠিকাদারের জয়েজয়কার : ২০২২ সালে যশোর সার্কেলে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় মানিক লাল দাসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে—তা আরও ভয়ঙ্কর।
কুষ্টিয়া জেলার একাধিক প্রকল্পে—প্রধান প্রকৌশলীর নির্দেশ অমান্য, সীমিত পদ্ধতির বদলে উন্মুক্ত দরপত্র, দরপত্র ওয়েবসাইটে প্রকাশ না করা, নিজের অনুমোদনেই প্রাক্কলন–ভেরিয়েশন–সময় বর্ধন
অভিযোগকারীরা দাবি করেছেন: “ওয়েবসাইটে দরপত্র না দিয়ে গোপনে দরপত্র খুলে নিজের লোককে কাজ পাইয়ে দেওয়াই ছিল তার মূল কৌশল।” এর ফলে সরকারি অর্থ কোথায় গেল, কাদের পকেটে গেল—এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

কুষ্টিয়া মেডিকেলের ছাদ ধস—মানিক লালের রহস্যময় অনুপস্থিতি : কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গাড়ি বারান্দার ছাদ ধসে পড়ার ঘটনাতেও তার নাম উঠে আসে।
অভিযোগ :,প্রকল্পে দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকলেও তিনি নাকি সাইটে যেতেন না, নির্মাণ কাজের অবহেলায় ছাদ ধস এবং চার কর্মকর্তা শাস্তি পেলেও মানিক লাল দাস ধরা–ছোঁয়ার বাইরে।
এ ঘটনা গণপূর্তের অভ্যন্তরীণ প্রশ্নকে আরও তীব্র করেছে—
“একজন প্রকৌশলী কি সত্যিই এত অপরাধ করেও অদৃশ্য থাকতে পারেন?”
বিদেশে অর্থ পাচার : ভারত ও কানাডায় বিনিয়োগ—বিস্ফোরক অভিযোগ : সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো—শত কোটি টাকার অবৈধ আয়কে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি— ভারতে বাড়ি কিনেছেন, ভারতীয় ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন, কানাডাতেও সম্পদ রয়েছে, পরিবারের সদস্যদের আয়কর ফাইলে অসংখ্য তথ্য গোপন এবং
কোটি কোটি টাকা কর ফাঁকি।
অভিযোগকারীদের বিশেষ মন্তব্য— “মানিক লাল দাসের পরিবারের NID-এর বিপরীতে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ট্রেস করলেই পুরো কেলেঙ্কারি বের হয়ে আসবে।”
ফোন বন্ধ, হোয়াটসঅ্যাপ ব্লক—নীরবতার দেয়ালে নিজের অবস্থান গুটিয়ে নিলেন মানিক ? মানিক লাল দাসের মতামত জানার জন্য প্রতিবেদক ফোন করলে তিনি তা রিসিভ করেননি।হোয়াটসঅ্যাপে অভিযোগ পাঠালে কোনও জবাব না দিয়ে বরং প্রতিবেদকের নম্বর ব্লক করে দিয়েছেন।
সাধারণত কোনও কর্মকর্তা অভিযোগ সত্য না হলে ব্যাখ্যা দিতে আগ্রহী হন। এ ক্ষেত্রে তার নীরবতা ও আচরণ—অনেককেই প্রশ্ন করতে বাধ্য করছে।
বিশ্লেষণ : মানিক লাল দাস কি একজন ব্যক্তি, নাকি দুর্নীতির প্রতিষ্ঠিত সিন্ডিকেটের প্রতীক? এই অভিযোগগুলোকে সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়— ব্যক্তিগত দুর্নীতির চেয়ে বড় সমস্যা হলো—একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব। ঠিকাদার–রাজনীতি–প্রকৌশলী—এই ত্রিবিধ বন্ধনে দক্ষিণাঞ্চলে দুর্নীতি ছিল প্রাতিষ্ঠানিক।
ওটিএম অপব্যবহার, গোপন দরপত্র, ভেরিয়েশন–সময় বর্ধন—এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে এটি ছিল “সিস্টেমেটিক করাপশন”। বিদেশে অর্থ পাচার ও রাজনীতিতে অর্থায়নের অভিযোগ তদন্তে সত্য হলে এটি পরিণত হবে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অর্থনৈতিক অপরাধে। চারটি শক্তিশালী সংস্থা একইসঙ্গে নড়ে ওঠা—রাষ্ট্র ইতোমধ্যে ঘটনাকে উচ্চ ঝুঁকির দুর্নীতি মামলা হিসাবে বিবেচনা করছে।
শেষ কথা : মানিক লাল দাসের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো শুধু একজন কর্মকর্তার অপকর্ম নয়— এগুলো গণপূর্ত অধিদপ্তরের দীর্ঘদিনের অস্বচ্ছতা, প্রভাব, কমিশন বাণিজ্য ও সিন্ডিকেট অর্থনীতির এক নোংরা এক্স-রে রিপোর্ট।
এখন প্রশ্ন— রাষ্ট্র কি এই তদন্তগুলো সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে পারবে? নাকি দক্ষিণাঞ্চলের এই “অঘোষিত সম্রাট” আবারও প্রভাবের আশ্রয়ে বাঁচতে পারবেন?সময়ই বলবে।
