
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর গুলশান-৬ নম্বর সড়কে অবস্থিত রাজউক চেয়ারম্যানের সরকারি আবাস—কথিত ‘চেয়ারম্যান বাংলো’—সংস্কারকাজে বহুমাত্রিক অনিয়ম ও জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর প্রমাণ মিলেছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এমন সব তথ্য, যা দেশের সরকারি প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ভয়াবহ অস্বচ্ছতা আবারও সামনে নিয়ে এসেছে।

শুরুর প্রাক্কলন ছিল মাত্র ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু নীরবে—প্রশাসনিক পর্দার আড়ালে—ওই ব্যয়膨 হয়ে দাঁড়ায় দুই কোটি ১৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রাক্কলনের প্রায় সাত গুণ বেশি। রাজউকের নিজস্ব তদন্ত অবশ্য এমন কোনো অনিয়মই পায়নি! তদন্ত কতটা ‘নির্দেশনানির্ভর’ ছিল—সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
দরপত্রের আগেই ৮০% কাজ শেষ—অভূতপূর্ব সরকারি বিধি লঙ্ঘন : গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত নথি বলছে— চেয়ারম্যান বাংলোর ৮০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর দরপত্র আহ্বান করা হয়। অর্থাৎ কাজ প্রায় শেষ, তারপর ‘দরপত্র-নাটক’। সরকারি ক্রয়বিধির এমন নির্লজ্জ লঙ্ঘন আগে খুব কমই দেখা গেছে।

তদন্তে অনিয়মের ঘটনাগুলো সরাসরি যুক্ত করেছেন—রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান (সম্প্রতি মৃত্যু), প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাহাত মুসলেমীন। কমিটির ভাষ্য—এদের ভূমিকা না থাকলে এ ধরনের ‘অপারেশন’ সম্ভবই নয়।

দুটি তদন্ত—দুটি বিপরীত ফলাফল! রহস্য কোথায় ? সংস্কারকাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই রাজউক নিজে তদন্ত কমিটি গঠন করে। এবং অবিশ্বাস্যভাবে— মাত্র সাত দিনের মাথায় জানিয়ে দেয় : “সবকিছু নিয়ম মেনে হয়েছে। কোনো অনিয়ম নেই।”
কিন্তু যখন মন্ত্রণালয় ২৯ জুন নতুন করে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে, তখন প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসে। কমিটির ২৭ আগস্ট জমা দেওয়া প্রতিবেদনে উঠে আসে— কাজ শুরু হয়েছে নকশা ছাড়াই, প্রাক্কলন অনুমোদনহীন অবস্থায়, দরপত্রের আগেই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এনডিই কাজ শুরু করে, পরে ‘বাঁধা এড়াতে’ তড়িঘড়ি করে দুই কোটি ৮৫ লাখ টাকার প্রাক্কলন বানানো, চাপ আসতেই ৬৯ লাখ কমিয়ে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দুই কোটি ১৬ লাখ টাকায় নামানো, এ যেন বৈধতার আচ্ছাদনে অবৈধতার ‘উচ্ছৃঙ্খল প্রদর্শনী’।
নকশা নেই, অনুমোদন নেই, দরপত্র নেই—তবু কাজ চলছে !তদন্তে আরও ধরা পড়ে— ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই) ও মেসার্স নিয়াজ ট্রেডার্স যৌথভাবে কাজ চালায়। এনডিই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে—তারা বাংলোতে শ্রমিক দিয়েছে। অথচ রাজউকের তদন্ত বলেছে—সব কাজ নাকি ই-জিপিতে স্বচ্ছ দরপত্রে ! এ দুই প্রতিবেদনের বিরোধী বক্তব্যই প্রমাণ করে—তথ্য আড়াল করা হয়েছিল।
অন্যায় রুখতে চাওয়া কর্মকর্তা ‘চাপের মুখে’ : নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কাইছার কাজের অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুললে পরিস্থিতি আরও অস্বস্তিকর মোড় নেয়। তিনি নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়টি লিখিতভাবে জানালে সাবেক চেয়ারম্যানের তীব্র চাপে তাঁকে সেই চিঠি প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়। একজন সরকারি প্রকৌশলীকে এভাবে নীরব করার চেষ্টা প্রশাসনের অন্তর্গত ভয়ঙ্কর দাপটেরই প্রকাশ।
তদন্তে দায়ী শনাক্ত, কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ ‘দায়ী বাঁচানোর মোড়কে’ : গণপূর্ত তদন্ত কমিটি দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করলেও, মন্ত্রণালয় ২৫ সেপ্টেম্বর যে নির্দেশনা দিয়েছে তা অনেকেই দেখছেন ‘লো-প্রোফাইল ফাঁকফোকর তৈরির কৌশল’ হিসেবে।নির্দেশনা তিনটি—কাজের মান যাচাই, কৃচ্ছ্র নীতি অনুসরণ এবং ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ।
অভিযোগকারীরা প্রশ্ন তুলছেন— “দুই কোটি টাকা কোথায় গেল—তার জবাব নেই। দায়ীদের শাস্তির নির্দেশ নেই। অথচ ঠিকাদারের বিল পরিশোধের নির্দেশ আছে!” রাজউকও দায়ীদের বিরুদ্ধে কেবল দুই কর্মকর্তাকে শোকজ করে দায় সেরেছে।
‘দায় কার?’—প্রশ্নের উত্তর দিতে নারাজ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ : তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জহিরুল ইসলাম খান বলছেন—“আমরা যা পেয়েছি, সব উল্লেখ করেছি। ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয় ও রাজউক।”
অন্যদিকে রাজউকের সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) ড. মো. আলম মোস্তফা দাবি করছেন— “আমরা কোনো নতুন নির্দেশনা পাইনি।” গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
সারসংক্ষেপ : প্রশাসনিক দুর্নীতির আরেকটি নির্মম উদাহরণ, ৩০ লাখের কাজ→ দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ১৬ লাখে, দরপত্রের আগেই ৮০% কাজ শেষ, তদন্ত দমাতে চাপ ও তথ্য-গোপন এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেই। রাজধানীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি আবাসগুলোর একটি—চেয়ারম্যান বাংলো—সংস্কারকে কেন্দ্র করে এই অনিয়ম এখন ঢাকার প্রশাসনিক অঙ্গনে নতুন এক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই বলছেন— “যদি একটি বাংলোর সংস্কারেই এমন অস্বচ্ছতা থাকে, তাহলে আরও বড় প্রকল্পগুলোর বাস্তবতা কী—তা সহজেই অনুমেয়।”
