৭৮ লাখ টাকার ‘অদৃশ্য কাজের’ বিল : গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলামের চারপাশে দুর্নীতির ঘূর্ণিঝড়

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক :  স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা ৭৮ লাখ টাকার পুরোটা খরচ হলো—কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, মাঠে কাজ হয়নি, কাগজে সব শেষ !


বিজ্ঞাপন

গণপূর্ত অধিদপ্তরের শেরে বাংলা নগর বিভাগ–২–এর নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলামকে ঘিরে উঠেছে এমনই এক ভয়াবহ, চলচ্চিত্রকেও হার মানানো দুর্নীতির অভিযোগ। সূত্রগুলোর ভাষায়—“কাজ হয়নি, অথচ বিল হয়েছে—এ যেন সরকারি অর্থ নয়, ব্যক্তিগত চেকবই।”

বরাদ্দ, দরপত্র আর জাদুর কৌশল : হাসপাতাল তিনটি, কাজের বাস্তবতা শূন্য : স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল— ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতাল (শ্যামলী), ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (মোহাম্মদপুর), ১০০ শয্যা মা ও শিশু হাসপাতাল।


বিজ্ঞাপন

বরাদ্দ পাওয়া মাত্রই নেমে আসে অস্বাভাবিক তৎপরতা। দরপত্র আহ্বান করা হয় হতবাক করা গতিতে। তারপর ? মাঠে কাজ সম্পন্ন হয়নি—তারও তোয়াক্কা নেই। জুন মাসেই বিল পরিশোধ, যেন কাজ শেষের সনদ নয়, বরং “দ্রুত বিল নিষ্পত্তির জরুরি নির্দেশ” ছিল। গণপূর্তের একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভের সুরে বলেন—“এটি তড়িঘড়ি নয়, এটি সরকারি অর্থব্যবস্থার নিয়মের সরাসরি অমান্য। ভয়ংকর দৃষ্টান্ত।”


বিজ্ঞাপন

একই ঠিকাদার, একই নাটক—অভিযোগ সিন্ডিকেটের ছায়া ঘন : তদন্তে বেরিয়ে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য—সব কাজ হয়েছে LTM পদ্ধতিতে, এবং অংশ নিয়েছে এক কিংবা দুইজন একই ঠিকাদার, যারা প্রকৌশলীর “ঘনিষ্ঠ বলয়ে” থাকেন বলে অভিযোগ।

PPR অনুযায়ী— প্রতিযোগিতা না থাকলে দরপত্র বাতিল করার নিয়ম। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষায়— “এই নিয়মের কবর রচনাই হয়তো আগে হয়ে গেছে।” আরেকজন ক্ষুব্ধ কর্মকর্তা বলেন—“এক–দুইজন ঠিকাদার দিয়ে বছরের পর বছর কাজ করানোর পেছনে ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া আর কী থাকতে পারে?”

মাঠে ধুলোও উড়েনি, কাগজে ১০০% কাজ—অসাধারণ সরকারি ‘ম্যাজিক’ :  তদন্ত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন— টিবি হাসপাতালে কাজ হয়েছে মাত্র ২০–৩০%, মা ও শিশু হাসপাতালের অনেক সেকশনে শ্রমিকই যায়নি, ফার্টিলিটি সেন্টারের ভাঙা অংশ আগের মতোই পড়ে আছে।

তবুও চূড়ান্ত প্রতিবেদনে লেখা—“সব কাজ ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় সম্পন্ন।” অভিযোগকারীরা ব্যঙ্গ করে বলেন—“এটি অনিয়ম নয়, এটি পরিকল্পিতভাবে সরকারি অর্থ লুটের এক নিখুঁত প্রকৌশল।”

প্রকৌশলী জহুরুলের বক্তব্য : ‘সবই ঠিক আছে’—তার সঙ্গে আছেন বড় বড় ব্যক্তিত্ব !  অভিযোগ নিয়ে যোগাযোগ করলে জহুরুল ইসলাম ক্ষুব্ধভাবে অস্বীকার করে বলেন—“সব নিয়ম মেনেই কাজ হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টির পরই বিল দেওয়া হয়েছে।”

এ পর্যায়ে তিনি আরও একটি ‘চাঞ্চল্যকর তথ্য’ যোগ করেন—তার নাকি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, তার মামা হাদী, মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম, এমনকি তথ্য উপদেষ্টা কার্যালয় পর্যন্ত গভীর যোগাযোগ রয়েছে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— “দুদকেও তার ঘনিষ্ঠজন আছেন”—এমন মন্তব্যও নাকি তিনি করে থাকেন।

এ যেন সরকারি দপ্তরের কর্মী নন, অন্তর্বর্তী সরকারের ‘অঘোষিত ভিআইপি’! তবে তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি সম্পূর্ণ ভিন্ন—“প্রত্যয়নপত্রও নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। মাঠে কাজ না হলেও কাগজপত্র আগেই সাজিয়ে রাখা ছিল।”

আইন যা বলে : কাজ ছাড়া বিল = শাস্তিযোগ্য অপরাধ :  সরকারি নিয়ম অনুযায়ী— অসম্পূর্ণ কাজ দেখিয়েও বিল উত্তোলন, দরপত্রে প্রতিযোগিতা না থাকা এবং সিন্ডিকেটভিত্তিক ঠিকাদার নিয়োগ সবই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর জন্য দায়ী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে—বিভাগীয় ব্যবস্থা, সাময়িক বরখাস্ত, আর্থিক জরিমানা এবং আত্মসাৎ করা অর্থ ফেরত সবই প্রযোজ্য।

সচেতন মহলের দাবি : ব্যাপক তদন্ত, কঠোর জবাবদিহি : স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন—“এ ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে সরকারি ব্যবস্থাপনা কতটা ভঙ্গুর। অভিযোগ সত্য হলে এর দায় এক ব্যক্তির নয়—পুরো ব্যবস্থার।” তারা স্বাধীন, স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানান।

শেষকথা :  ৭৮ লাখ টাকার কাজ না করেই বিল—এ ঘটনা শুধু দুর্নীতি নয়, এটি এক নির্বিকার প্রশাসনিক ব্যঙ্গচিত্র, যেখানে কাজের মূল্য নেই,  কাগজের ‘পারফরম্যান্স’ই যথেষ্ট।

গণপূর্তের এই নীরব লুটের ‘মহোৎসব’—এখন জাতির সামনে বড় প্রশ্ন তোলে : কাজ ছাড়া বিল—এটাই কি নতুন স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন মডেল?

👁️ 76 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *