
নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশজুড়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে দাপট দেখানো দুর্নীতি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দুদকের ধারাবাহিক অভিযানে টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও ঢাকায় তিনটি পৃথক এনফোর্সমেন্ট টিম পরিচালিত হয়েছে। অভিযানে উঠে এসেছে বহুতল ভবন নির্মাণে ভয়াবহ অনিয়ম, স্বাস্থ্যখাতে অদেখা নৈরাজ্য এবং গণপূর্তের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের বিল পরিশোধে দীর্ঘদিনের ঘুষ বাণিজ্যের তথ্য।

অভিযান সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন—সংগ্রহ করা তথ্য-উপাত্তের মধ্যে রয়েছে এমন সব দলিল–প্রমাণ, যা পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মুখোমুখি হলে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা, ঠিকাদার এবং প্রভাবশালী মহল ধরা পড়তে বাধ্য।
টাঙ্গাইলে অনুমোদনহীন ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন: অন্ধকারের ভেতর ‘নীরব বিপর্যয়’ : পৌর কর্তৃপক্ষ ও বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কমিটির অনুমোদন ছাড়াই দ্রুতগতিতে মাথা তুলছিল একের পর এক বহুতল ভবন—এমন অভিযোগের ভিত্তিতে দুদকের জেলা কার্যালয় টাঙ্গাইল একটি আকস্মিক এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে দুদক টিমের সঙ্গে যোগ দেয় গণপূর্ত বিভাগ, জেলা প্রশাসন এবং পৌরসভার প্রতিনিধি দল।

সরেজমিন পরিদর্শনে বেরিয়ে আসে একের পর এক ভয়াবহ চিত্র —কোনো ধরনের নকশা অনুমোদন ছাড়াই চলছে বহুতল নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ ডিজাইন ও নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী, এবং মালিকদের নথির নামে মুখে মুখে ‘অদৃশ্য সুরক্ষা বলয়’। টিম ঘটনাস্থল থেকে গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে। প্রাথমিক বিশ্লেষণে অনিয়মের সুস্পষ্ট সত্যতা নিশ্চিত হয়েছে। রেকর্ডপত্রের পূর্ণ বিশ্লেষণ শেষে টিম বিস্তারিত প্রতিবেদন কমিশনে পাঠাবে—যা বড় ধরনের তদন্ত ও আইনি পদক্ষেপের পথ খুলে দিতে পারে।

শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: সেবায় নৈরাজ্য, রোগীর খাবারে প্রতারণা ও ওষুধের অদৃশ্য গায়েব ! স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে হয়রানি, দুর্ব্যবহার, খাবার সরবরাহের অনিয়ম, ওষুধের স্টক ঘাটতি—এমন একগুচ্ছ গুরুতর অভিযোগের ভিত্তিতে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুদক টিম ছদ্মবেশে প্রবেশ করে।
টিমের সরেজমিন পর্যবেক্ষণে যা পাওয়া যায় তা কোনো সরকারি হাসপাতালে ঘটনার সঙ্গেই ন্যূনতম সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়— বহিঃবিভাগ, জরুরি বিভাগ ও বিভিন্ন ওয়ার্ড অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন, ওয়ার্ড ও ওয়াশরুমের অবস্থা রোগী মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলার মতো, ডায়েট চার্ট অনুযায়ী খাবারের ওজনে সুস্পষ্ট গরমিল, ঠিকাদার বিধিবহির্ভূতভাবে সাব–ঠিকাদারের মাধ্যমে খাবার সরবরাহ করছেন, ওষুধের স্টক রেজিস্ট্রারে বড় ধরনের গরমিল এবং বাস্তব মজুদের ঘাটতি, রোগীরা অভিযোগ করেছেন—নিয়মিত খাবার তাদের দেওয়া হয় না, কম্পাউন্ডের বাসা বরাদ্দেও সরাসরি অনিয়ম।
অভিযান শেষে দুদক টিম সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জরুরি ভিত্তিতে—
সেবার মানোন্নয়ন, পরিচ্ছন্নতা, নিয়মিত খাবার সরবরাহ, ওষুধ সংরক্ষণ ও বিতরণে কড়া নজরদারির পরামর্শ দিয়েছে।
ঘটনার গভীরতা বিবেচনায় পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাঠানো হবে কমিশনে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরে বিল পরিশোধে ঘুষ বাণিজ্য: ৬ বছরের রেকর্ড জব্দ : গণপূর্ত অধিদপ্তরে ‘উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ’ কাজের বিল পরিশোধে ঠিকাদারদের কাছ থেকে নিয়মিত ঘুষ আদায়ের অভিযোগ পেয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয় আরেকটি উল্লেখযোগ্য এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করে।
অভিযানকালে টিম—২০১৮–২০১৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩–২০২৪ পর্যন্ত সকল কার্যাদেশ, ঠিকাদারদের বিল পেমেন্ট রেকর্ড, এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করে।
এই সময়ের মধ্যে বহু ঠিকাদার মিলিয়ন ডলারের প্রকল্পে কাজ করেছেন, আর তারা অভিযোগ করেছেন—ঘুষ ছাড়া কোনো বিল ছাড় হয়নি। সংগৃহীত রেকর্ডপত্রের বিশদ বিশ্লেষণ শেষে টিম যে প্রতিবেদন দাখিল করবে তা গণপূর্তের দীর্ঘদিনের অন্ধকার চক্র উন্মোচনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
দুদকের একাধিক অভিযান—একটি বার্তা: অনিয়ম ঢাকতে আর পার পাওয়া যাবে না : টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও ঢাকায় একই দিনে তিনটি বড় ধরনের অভিযান দেখিয়ে দিল—দেশের প্রশাসন, স্বাস্থ্যখাত ও গণপূর্ত বিভাগে গড়ে ওঠা দুর্নীতির নেটওয়ার্ক আর আগের মতো নিরাপদ নয়। অভিযানের প্রাথমিক ফলেই অনিয়মের সত্যতা মিলেছে; পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা হলে একাধিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট ধরা পড়ার আশঙ্কা জোরালো।
