মোবাইল পাচার চক্রের আন্তদেশীয় নেটওয়ার্ক

অপরাধ

নিজস্ব প্রতিবেদক : ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি (আইএমইআই) নম্বর মুছে ও পরিবর্তন করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পাচার হচ্ছে ছিনতাই ও চুরি হওয়া বিভিন্ন ব্রান্ডের দামি মোবাইল। বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া ও চীনকেন্দ্রিক আন্তদেশীয় একটি চক্র গড়ে ওঠেছে এই মোবাইল ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস পাচারে। আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনের জন্য যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সফটওয়্যার দরকার হয়, সেটিও আমদানি করছে একটি চক্র।
মাস দেড়েক আগে প্রকাশ্য রাজপথ থেকে পরিকল্পনামন্ত্রীর যে মোবাইল ছিনতাই হয়েছিল, সেটিও এই চক্রটির হাতে পড়েছে কিনা তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে মন্ত্রীর মোবাইল ফোন উদ্ধার করতে গিয়ে এরইমধ্যে বের হয়ে এসেছে অনেক তথ্য।
গত ২৬ জুন দুপুরে রাজধানীর রমনা মডেল থানার সিদ্ধেশরীর আনারকলি সুপার মার্কেটের চতুর্থতলার “মোবাইল কেয়ার” নামক একটি দোকানে অভিযান পরিচালনা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি টিম। ঢাকা মেট্রো পূর্বের এই টিমটি ওই দোকান থেকে আট লাখ টাকার চোরাই মোবাইল ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসসহ তিন জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত এই তিন জন হলো, কসবার সুজারক সুজন (২৯), বরিশালের বানারীপাড়ার আসাদুজ্জামান (৩৪) ও নোয়াখালী সুধারামের আকাশ শাহরিয়ার (২৯)।
এদের মধ্যে আসাদুজ্জামান গুলিস্তান ও মিরপুর এলাকা থেকে চোরাই মোবাইল ফোন সংগ্রহ করতো। সেগুলো ওই মোবাইল কেয়ার দোকানে নিয়ে আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে তুলনামূলক কম দামে বাজারে বিক্রি করতো।
সিআইডি’র ঢাকা মেট্রো পূর্ব বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার ফাতেমা জান্নাত বলেন, ‘বিশেষ এক ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করে মোবাইলগুলোর আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে মনগড়া নতুন আইএমইআই নম্বর বসিয়ে বাজারে বিক্রি করা হতো।’
চক্রটির কাছ থেকে বিভিন্ন ব্রান্ডের শতাধিক মোবাইল ও ইলেক্ট্রনিক্স বিভিন্ন ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও আইএমইআই নাম্বার পরিবর্তনের কাজে ব্যবহৃত ভারত ও চায়নার বিভিন্ন ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। সেগুলো হলো- ঝরমসধ ইড়ী, ঊধংু ইড়ী ও ঐণউজঅ-ঞঙঙখ। এসব ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস আইএমইআই নাম্বার পরিবর্তন কাজে ব্যবহার করে।
চক্রটি একটি চোরাই স্মার্টফোনের আইএমইআই নাম্বার পরিবর্তনের জন্য মাত্র দুই মিনিট সময় নেয়। আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনের জন্য হাইকনফিগারেশনের কম্পিউটার ব্যবহার করতো এই চক্রটি। তাদের কাছ থেকে আইএমইআই পরিবর্তনের কাজে ব্যবহৃত তিন টেরাবাইট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কম্পিউটার হার্ডডিস্ক উদ্ধার করা হয়, যার গায়ে লেখা রয়েছে থাইল্যান্ডের তৈরি।
আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করার পরও চক্রটি যদি কিছু মোবাইল সেটকে দেশে ব্যবহার বিপজ্জনক মনে করে, তখন তারা সেগুলোকে পাচার করে দেয় প্রতিবেশী ভারত, চীন, থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায়। মূলত মোবাইল যন্ত্রাংশ আমদানির সঙ্গে জড়িত অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব দেশে যাওয়ার সময় চোরাই মোবাইল ফোনগুলো নিয়ে যায়। সেখানে এসব ফোন বিক্রি করে আসে তারা।
সিআইডির সূত্রটি জানায়, তাদের হাতে গ্রেফতার হওয়া চক্রটি চোরাই মোবাইলগুলো সাধারণত ছাত্রদের কাছে কম দামে বিক্রি করতো। যেগুলো ব্যবহার করলে ধরা পড়তে পারে সেগুলো কখনও আর চালু করতো না তারা, বাইরে পাঠিয়ে দিতো।
ফাতেমা জান্নাত বলেন, ‘আমরা শুনতে পেয়েছি দামি চোরাই ফোন বিদেশে পাচার হয়। তবে আমরা এখনও এই চক্রটিকে ধরতে পারিনি। আমরা যাদের গ্রেফতার করেছি, তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন জড়িত রয়েছে, তাদের গ্রেফতারে কাজ চলছে। তাদের গ্রেফতার করা হলে এ বিষয়ে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তখন হয়তো বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।’
গত ৩০ মে সন্ধ্যায় বিজয় সরণি এলাকা থেকে ছিনতাই হয় পরিকল্পনামন্ত্রীর ফোন। গাড়িতে বসে তিনি ফোনে কথা বলছিলেন, জানালা খোলা ছিল, বাইরে থেকে ছিনতাইকারী হাত ঢুকিয়ে ফোনটি নিয়ে চম্পট দেয়। এ ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাফরুল থানায় মামলা হয়। পুলিশ ব্যাপক অনুসন্ধান করে। সন্দেহভাজন চার জনকে গ্রেফতারও করা হয়। তবে ফোনটি এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার আসম মাহাতাব উদ্দিন বলেন, ‘মন্ত্রীর ফোনটি সর্বশেষ ৩০ হাজার টাকায় হাতিরপুলের একটি দোকান থেকে বিক্রি হয়েছে। তবে যার কাছে বিক্রি হয়েছে, তার ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। আশা করছি তাকে দ্রুত শনাক্ত করা যাবে।’
হাতিরপুলের দোকান থেকে ফোনটি যার কাছে বিক্রি করা হয়েছে, তাকে ধরা গেলেও ফোনটি উদ্ধার সম্ভব হবে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউই। এরইমধ্যে মন্ত্রীর ফোনের আইএমইআই নাম্বার পরিবর্তন করা হয়ে গেছে কিনা, অথবা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে কিনা, সে বিষয়েও কোন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।


বিজ্ঞাপন