কেউ কথা রাখেনি

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ স্বাস্থ্য

হ-য-ব-র-ল স্বাস্থ্যবিধি

 

বিশেষ প্রতিবেদক : কেউ কথা রাখেননি। কারখানা খোলার জন্য সরকারকে দেওয়া কথা রাখেননি গার্মেন্টস মালিকরা। সরকারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করেই কারখানা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য সরকারের সব উদ্যোগকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে পানিতে। ২৩ জুলাই শুরু হওয়া ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন এখন সাধারণ মানুষের কাছে হাসি তামাশায় পরিণত হয়েছে। আর এর জন্য প্রতিনিয়তই সরকারকে নানামুখী সমালোচনা শুনতে হচ্ছে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, সরকারের দূরদর্শিতা ও দক্ষতা নিয়েও।
সরকারঘোষিত ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ অনেকটাই ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। এরই মধ্যে আরো ৫দিন বাড়ানো হয়েছে লকডাউন। জনসাধারণ প্রয়োজনে যেমন ঘর থেকে বের হচ্ছে, তেমনি বিনা কারণেও বের হচ্ছে। প্রধান সড়কগুলোতে গণপরিবহন না চললেও ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, রিকশা অবাধে চলাচল করছে।
এ ছাড়া পুলিশের চেকপোস্টগুলোতেও লকডাউনের শুরুতে যেমন কড়াকড় ছিল, এখন তা দেখা যাচ্ছে না। বেশিরভাগ চেকপোস্ট অবাধে পার হয়ে যাচ্ছে রিকশার যাত্রীরা।
মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে লকডাউনের এমনি চিত্র দেখা গেছে। তবে গণপরিবহন না চালাচল করায় রাজধানীতে চিরচারিত যানজট দেখা যাচ্ছে না।
মেরুল বাড্ডা থেকে রিকশায় মতিঝিলের অফিসে এসেছেন আশিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘মেরুল বাড্ডা থেকে মতিঝিল আসতে ২০০ টাকা রিকশা ভাড়া দিতে হয়েছে। মোটরসাইকেলে আসলে খরচ আরও কম হতো। তবে চেকপোস্টে মাঝে-মধ্যে মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে চেক করে পুলিশ। রিকশায় আসলে এই ঝামেলায় পড়তে হয় না। তাই বাড়তি ভাড়া দিয়ে রিকশায় এসেছি।’
তিনি বলেন, ‘বাসা থেকে অফিসে আসার পথে রামপুরা টেলিভিশন ভবনের সামনে পুলিশের চেকপোস্ট আছে। চলমান লকডাউনের শুরুর দিকে এই চেকপোস্টে বেশ কড়াকড়ি ছিল। এখন আর কোনো কড়াকড় নেই। আজ দেখলাম চেকপোস্টের পুলিশ অনেকটাই নীরবে দায়িত্ব পালন করছে। রিকশা, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল সবকিছু অবাধে চেকপোস্ট পার হয়ে যাচ্ছে।’
যাত্রাবাড়ী থেকে রিকশায় বিজয়নগর অফিসে আসা রাখি আক্তার বলেন, ‘রাস্তায় সবকিছুই চলছে, শুধু গণপরিবহন চলছে না। এতে আমাদের মতো স্বল্প বেতনের কর্মীদের কষ্ট হচ্ছে। গণপরিবহন চালু থাকলে ২০ টাকা দিয়েই অফিসে আসতে পারি। এখন রিকশায় ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। এ অবস্থা চললে বেতনের বেশিরভাগ টাকা রিকশা ভাড়া বাবদ চলে যাবে।’
মালিবাগ মোড়ে কথা হয় রিকশাচালক আজগর আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘লকডাউনের শুরুর দিকে তেমন ভাড়া পেতাম না। দুদিন ধরে একটু বেশি ভাড়া পাচ্ছি। তবে স্বাভাবিক সময় থেকে এখন অনেক কম আয় হচ্ছে। দিনে ৪০০ টাকা ভাড়া মারায় কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে অর্ধেক বেলাতেই ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ভাড়া পেতাম।’
তিনি বলেন, ‘চলমান লকডাইনের প্রথমদিকে মাঝে-মধ্যে পুলিশ হয়রানি করতো। ভয়ে ভয়ে রিকশা চালাতাম। কয়েকদিন ধরে পুলিশ কিছু বলে না। যাত্রী নিয়ে সহজেই রাস্তায় চলাচল করতে পারছি। আগের তুলনায় রাস্তায় মানুষের যাতায়াত অনেক বেড়েছে।’
আবুল হোটেল এলাকায় ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করা এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগের তুলনায় এখন রাস্তায় মানুষের চলাচল বেড়েছে, এটা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এখন গার্মেন্টস কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবে মানুষের চলাচল বাড়বে। স্বাভাবিক সময়ের মতো যানজট নিয়ন্ত্রণে আমাদের হয়তো অত বেগ পেতে হয় না, কিন্তু নিয়মিতই ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। কারণ এই মোড়ের সব রাস্তাতেই গাড়ি চলাচল করছে।’
চলতি বছরের শুরুর দিকে দ্বিতীয় দফায় করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করার পর যখনই সরকার এটি নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে তখনই বাগড়া দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে গার্মেন্টস মালিকরা। বারবারই তারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়ার কথা বলছেন। তাদের দাবি, অর্ডার অনুযায়ী পণ্য শিপমেন্ট করতে না পারলে অর্থনীতি হারিয়ে যাবে।
সেই ধারাবাহিকতায় গত রোববার (৩০ জুলাই) ১৪ দিনের লকডাউনের ৯ম দিনে এসে ১ আগস্ট থেকে গার্মেন্টসসহ শিল্প কারখানা খুলে দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কারখানা খুলে দেওয়ার আবেদন নিয়ে বারবার সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন তারা। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর বরাবর আবেদন নিয়ে গেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে। দু-দফা আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সঙ্গে তৈরি পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট আরও চারটি সংগঠন ছিল। তারা বারবারই সরকারকে বোঝাতে চেয়েছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা চালানো হবে।
শ্রমিকরা বলছে, কারখানার আশেপাশের শ্রমিকদের দিয়েই কারখানা চালানোর কথা বলে অনুমোদন নিয়ে নিলেও ১ আগস্ট সকালে কাজে যোগ দিতে ফোন করা হয় তাদের। রবিবার সকালে কাজে যোগ দিতে না পারলে তাদের আর কারখানায় আসতে হবে না বলেও জানানো হয়েছে। দায়িত্বশীলরাই এ ফোনগুলো করেছেন বলে একাধিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন গার্মেন্টস কর্মীরা।
এ প্রসঙ্গে আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক বেলায়েত হোসেন জানান, শ্রমিকরা চাকরি বাঁচাতে মাইলের পর মাইল হেঁটে কর্মস্থলের দিকে যাচ্ছেন অথচ কেউ এদের পরিশ্রান্ত মুখটা দেখছেন না। ঈদের একদিন আগ পর্যন্ত লেগেছিল ২৩ জুলাই শুরু হওয়া লকডাউনে কারখানা খোলা থাকবে কী থাকবে না এই সিদ্ধান্ত নিতে। সরকার সিদ্ধান্ত নিলো ৫ তারিখ পর্যন্ত কল-কারখানা বন্ধ থাকবে। আমরা শ্রমিকরা বাড়ি গেলাম। হঠাৎ করে আমাদের ফোন করে জানানো হলো ১ তারিখ থেকে কারখানা খুলবে। এর আগেই কারখানার গেটে পৌঁছাতে হবে, না পারলে আর কারখানায় আসা লাগবে না। আমরা বাধ্য হয়ে পেটের তাগিদে কর্মক্ষেত্রে এলাম। কিন্তু পরিবহন বন্ধ রেখে শ্রমিকরা কিভাবে ফিরবে সেটা কেউই ভাবেননি।
যদিও সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, কারখানা মালিকরা কোনও শ্রমিককে কাজে যোগ দিতে ঢাকায় আসতে বলেনি। শ্রমিকদের আসার জন্য কোনও মালিক বাধ্য করছে না।
এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীরা সরকারকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কারখানার আশপাশের শ্রমিকদের নিয়েই প্রথমে কারখানা চালু করবেন। ঈদের ছুটিতে গ্রামে যাওয়া শ্রমিকরা ৫ আগস্টের পর কাজে যোগ দেবেন। এতে কেউ চাকরিচ্যুত হবেন না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। মন্ত্রী বলেন, একদিনের মধ্যে শ্রমিকদের ফিরে আসার নির্দেশনায় ফেরিঘাটগুলোতে রীতিমতো ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়।


বিজ্ঞাপন

 

👁️ 3 News Views