অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুতে আয় কোটি টাকা

অন্যান্য অপরাধ অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন জীবনী ঢাকা রাজধানী

বস্তির রুম ভাড়া

বিশেষ প্রতিবেদক : রাজধানীর মিরপুরে রূপনগর, চলন্তিকা, আরামবাগ বস্তি থেকে মালিকরা প্রতি মাসে উপার্জন করেন কয়েক কোটি টাকা। রুম কিনে তা ভাড়া দেওয়া, বস্তিতে অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ দিয়ে টাকা উপার্জন করছেন তিন বস্তির মালিকধারী প্রভাবশালীরা। তাদের সহযোগিতার জন্য রয়েছেন অবৈধ সংযোগ দেওয়ার লাইনম্যান ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা।
শুক্রবার রাতে লাগা আগুনে রূপনগর চলন্তিকা, ঝিলপাড় ও আরামবাগ বস্তি কমপক্ষে ২৫ হাজার ঘর পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ সব ঘরে অন্তত ৫৫ হাজার লোকের বসবাস ছিল।
সরেজমিনে জানা যায়, যারা এতদিন কাড়ি কাড়ি টাকা উপার্জন করে আসছিলেন, আগুন লাগার পর কেউ বস্তিবাসীদের খোঁজ নিতে আসেনি। শুধু রুমের মালিকরা নয় যারা বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি বিল নিচ্ছিলেন তারা আগুন লাগার পর একবারও আসেননি।
শাহীনুর বেগম ঈদের ছুটিতে গিয়েছিলেন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার কসবায়। চার মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে তার সংসার। স্বামী সেলিম মিয়া বাবুর্চির কাজ করেন। তিন মেয়ে স্কুলে পড়ে। বই খাতা পোশাক সব পুড়ে গেছে। যা গতকাল সকালে গ্রাম থেকে ফিরেই জানতে পারেন। শাহীনুর বেগম বলেন, যে মালিকের (সালাম মিয়ার বাসা) বাসায় ভাড়া ছিলেন তিনিও খোঁজ নেননি। অথচ কয়েকদিন আগেও মাসের ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও গ্যাস বিল বাবদ কতগুলো টাকা পরিশোধ করেছি। মালিককে ফোন দিলেও রেসপন্স করেননি।
শাহীনুর শুধু নয়, মালিকের প্রতি অভিযোগের তীর আরও অনেক ভাড়াটিয়ার। মিনু বেগম তার ছেলে মিরাজ ও স্বামী কামালকে নিয়ে ঈদের ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। কাল সন্ধ্যায় ঢাকার উদ্দেশে লঞ্চে ওঠেন। জানতেই পারেননি যে ভয়াবহ আগুনে তার সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। আজ এসে সবকিছু পোড়া দেখেই যেন আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়। মিনু বেগম বলেন, শনিবার সকালে মালিক মাজেদ মিয়ার বাড়িতে গেলেও তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, নিজের ২০টি ঘর পুড়ে গেছে। সে চিন্তাতেই তো বাঁচি না। ঘর করতে পারলে আবারও তোমরা থাকবে, এখন কথা বলার সময় নেই।
মিনু বেগম জানান, প্রতি মাসে ঘর ভাড়া বাবদ দুই হাজার ৭০০ টাকা, বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৩০০ টাকা আর গ্যাস বিল বাবদ ৫০০ টাকা করে দিতে হতো। তার মালিকের ২০টি ঘর ছিল। ২০ ঘর থেকেই মালিক গ্যাস বিল বাবদ ৫০০ টাকা করে মোট ১০ হাজার টাকা তুলত। ভাড়া পরে দিলেও চলত তবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলের টাকা সবার আগে নিতো। পানির জন্যও ১০০ করে টাকা দেওয়া হতো।
গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির মিটার বাড়িগুলোতে ছিল কিনা জানতে চাইলে মিনু বেগম বলেন, কোনো বাসাতেই গ্যাস আর বিদ্যুতের মিটার ছিল না। সবই অবৈধ সংযোগ ছিল। তবে পানির মিটার ছিল। মালিকরা পানির বিল ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করেন বলে শুনেছি।
শনিবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত পুড়ে যাওয়া বাড়ির মালিকদের খোঁজ করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।
আরফিনা নামে একজন ভাড়াটিয়া বললেন, সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলতেই ঘরের মালিকরা লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে একটা কৌশল অবলম্বন করে মালিকদের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের।
প্রথমেই পাওয়া যায় বস্তির ঝিলপাড় অংশের একজন মালিক মোছা. ময়না বেগমকে। তিনি বলেন, আমার ৩০টি ঘর ছিল, যার চিহ্ন মাত্র নেই। ওইসব ঘরের দ্বিতীয় তলায় চারটিতে দুই মেয়ে এক ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে থাকতেন তিনি। বাকি ২৬টি ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন। রুম ভেদে ভাড়া ছিল ২২০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। রুম ভাড়ায় যে উপার্জন হয় তা থেকে দুলাল নামে একজনকে গ্যাস বাবদ ৫ হাজার টাকা ও বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৭ হাজার টাকা দিতে হয়।
এই দুলালই ঝিলপাড় অংশে যত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ রয়েছে তার সবই দিয়েছেন। প্রতিমাসে টাকাও কালেকশন করেন তিনি। এই অংশে কতগুলো ঘর ছিল জানতে চাইলে ময়না বেগম বলেন, প্রায় ১০ হাজার ঘর ছিল। সব টাকাই দুলাল এসে নিয়ে যায়।
দুলাল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই এলাকায় সবাই দুলালকে এক নামে চেনে। গ্যাস দুলাল বললে সবাই চেনে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা তার।
গ্যাস দুলালকে অনেক কষ্টে খুঁজে পাওয়া যায়। সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই তিনি যেন সিংহ হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, বলেন কী জানতে চান? অবৈধ গ্যাস সংযোগ আর বিদ্যুৎ সংযোগের কথা বলতেই তিনি বলেন, আমি কোটি টাকা তুলি, টাকাগুলো যায় কোথায় জানেন? সবাইকে দিয়ে খাই। কে খায় না সেটাই বলেন? গ্যাস ও বিদ্যুৎ অফিসের লোকেরাও এখানকার টাকার জন্য বসে থাকেন। ফোনের ওপর ফোন করতে থাকেন।
কারা তারা জানতে চাইলে দুলাল কারও নাম না বলেই মোটরসাইকেল চালু করে চলে যান তার গন্তব্যে।
আরামবাগ অংশে একজন মালিককে পাওয়া যায়। তার নাম আলমগীর হোসেন। গার্মেন্টসে উচ্চপদে চাকরি করেন। দেড় বছর হলো দুই লাখ টাকায় ৭টি ঘর কিনেছেন। এরপর সেখানে দু মাস আগে ৯৬ হাজার টাকা খরচও করেছেন বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, আরামবাগ অংশে অন্তত ৮ হাজার ঘর রয়েছে। এখানকার বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলের টাকা রহিম শিকদার নামে একজন লোক প্রতি মাসে নেন।
আরামবাগ অংশের চারটি ঘরের মালিক জাকির হোসেনও জানান যে, রহিম শিকদারই তাদের বিদ্যুৎ আর গ্যাস বিলের টাকা নেন। গ্যাসের জন্য প্রতি ঘর বাবদ ৫০০ টাকা আর বিদ্যুতের জন্য ৩০০ টাকা করে নেন।
রহিম শিকদারেরও দেখা মেলে একটি দোকানে। তিনি বলেন, আমি টাকা তুলে সবাইকে ভাগ করে দেই। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, গ্যাস-বিদ্যুতের অফিসের লোকসহ অনেককে এই টাকার ভাগ দিতে হয়। এখানে অবৈধ গ্যাস বিদ্যুৎ সংযোগ চলে তাই আমিও দিয়েছি। কেউ খাবে না, আমিও খাব না।
অন্যদিকে বস্তির চলন্তিকা অংশের অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের টাকা তোলেন শামসু মিয়া। চলন্তিকা অংশেও অন্তত সাত হাজার ঘর রয়েছে বলে জানান ঘরের মালিক আমজাদ হোসেন। জানতে চাইলে শামসু মিয়া বলেন, বেশির ভাগ বাসাতেই সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করা হয়। বিদ্যুতের লাইন দিয়েছি তবে সেটা নিজের মিটার থেকে। এর বেশি তিনি আর কিছু বলতে চাননি।
মিরপুর-৭ নম্বর সেকশনে যুব লীগ অফিস দিয়ে বসেছেন সোহেল রানা। এখন সেটি সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প। সোহেল রানা বলেন, প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা ওঠে ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ আর গ্যাস বিল থেকে। এখানে যারা ঘর ভাড়া দেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল তোলেন তাদের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। আওয়ামী লীগের বাইরে এখানে কেউ নেই। তারা বস্তিবাসীদের ভালো রেখেছে। এখন পুড়ে গেছে, নতুন করে আবার তৈরি হবে।
অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষযে জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামালের মোবাইল নম্বরে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে মিরপুর জোনের কমপ্লেইন সুপার ভাইজার ইউসুফ আলী এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *