
নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের গণপূর্ত অধিদপ্তর বহুদিন ধরেই ঠিকাদার সিন্ডিকেট, কমিশন বাণিজ্য ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভয়াশ্রম হিসেবে আলোচিত। বিগত সরকারের দীর্ঘ ১৭ বছরের শাসনামলে এই দপ্তরটি একদল প্রভাবশালী প্রকৌশলীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়—যাদের দাপট ছিলো রাজনৈতিক ক্ষমতার সমান। এই তালিকায় দুই নাম সবসময় সামনে আসে—তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. উজির আলী, এবং নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী মাশফিক আহমেদ।

দু’জনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ, সম্পদের পাহাড়, ঠিকাদার সিন্ডিকেট পরিচালনা, কমিশন বাণিজ্য—সবকিছুই যেন ছিল একেকটি সমান্তরাল সম্রাজ্য। একদলের ভাষায়— “গণপূর্তে কাজ নয়, কমিশনই প্রথম—এই দুইজন ছিল সেই অন্ধ সাম্রাজ্যের দুই মুখ।”
উজির আলী: প্রকৌশলী না ‘গণপূর্তের উজির’? ঢাকায় ১৭ বছর—বাইরে মাত্র চার মাস: রাজনৈতিক আশীর্বাদে অটুট অবস্থান : সূত্র বলছে, গত ১৭ বছরে উজির আলী ঢাকার বাইরে ছিলেন মাত্র চার মাস। এর বাইরে তিনি সবসময় রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ জোন—আজিমপুর, রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগসহ ক্ষমতাধর দায়িত্বগুলো ধরে রেখেছেন।

ঠিকাদার কমিশন–টেন্ডার সিন্ডিকেট–অস্বচ্ছতা: বারবার প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম : আজিমপুর জোনে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নুরানী কনস্ট্রাকশনের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, কমিশন বাণিজ্য এবং প্রকল্পে অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ ওঠে। ২০২২ সালের ২২ এপ্রিল জাজেস কমপ্লেক্সে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনাতেও তার বিরুদ্ধে দায়িত্বে গাফিলতি ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম না দেওয়ার অভিযোগ উঠে।

কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার প্রকল্প: গোপন তদন্তে ‘নাম উঠে আসা’ : রাষ্ট্রীয় গোপন তদন্তে দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িত যে ৩৭ কর্মকর্তার নাম ছিলো—সেখানে উজির আলীর নামও ছিলো বলে সূত্র দাবি করে।
অতিরিক্ত বিল কেলেঙ্কারি : জি কে শামিমের ঘটনা এবং ‘লঘু শাস্তি’ প্রশ্ন : ২০২১ সালের আলোচিত অতিরিক্ত বিল কেলেঙ্কারিতে তদন্ত কমিটিতেও ছিলেন উজির আলী। ওই মামলায় জড়িত প্রকৌশলী ফজলুল হক মধুর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে—যদিও তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন।
রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগে শতভাগ AAP কাজ OTM-এ নেওয়ার অনুমোদন—তিনগুণ কমিশন বাণিজ্য, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সম্পূর্ণ AAP কাজ OTM পদ্ধতিতে করার অনুমতি দিয়ে তিনি বড় অঙ্কের কমিশন নেওয়ার অভিযোগের মুখে পড়েন।
উজির আলীর ‘সম্পদের পাহাড়’: সূত্র বলছে শত শত কোটি টাকার মালিক : একাধিক অভ্যন্তরীণ সূত্রের দাবি—উজির আলী নামে–বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। অভিযোগ অনুযায়ী তার সম্পদ তালিকা যথাক্রমে, : উত্তরা ১২ সেক্টরে ৬ তলা ব্যক্তিগত ভবন, বসুন্ধরা ডি ব্লকে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, ধানমন্ডি স্টার কাবাব গলিতে ২০০০ স্কয়ারফিট ফ্ল্যাট, গাজীপুরে ৫ একর জমি (স্ত্রীর নামে), ব্যাংক হিসাব ও বিনিয়োগে অস্বাভাবিক লেনদেন, উজির আলী অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন—“আমি কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করিনি। আমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়, তাই পালন করি।”

গণপূর্তের আরেক বিতর্কিত নাম: ‘কাজী মাশফিক সিন্ডিকেট’ : ছাত্রলীগ পরিচয়–রাজনৈতিক ছায়া–প্রশাসনিক ক্ষমতা: এক ব্যক্তির আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ তেজগাঁও বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী মাশফিক আহমেদ এর বিরুদ্ধে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে ঠিকাদার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র বলছে, তিনি ছিলেন—ঠিকাদার নিয়োগের গোপন নিয়ন্ত্রক, কমিশন রেট নির্ধারক, প্রতিটি বিল পাসে বাধ্যতামূলক “কাট” নির্ধারক এবং কাজ না করেও ভুয়া বিল পাসের অন্যতম কারিগর।
ঠিকাদারদের অভিযোগ : ‘কমিশন না দিলে কাজ বন্ধ, , ঠিকাদাররা অভিযোগ করেছেন—কমিশন না দিলে বিল আটকে রাখেন, ভবিষ্যতের কাজ বাতিলের হুমকি দেন, কোটেশন জালিয়াতি করেন প্রকল্পে ভুয়া মেজারমেন্ট তৈরি করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেন
অস্বাভাবিক সম্পদ : বাড়ি–ফ্ল্যাট–বিলাসবহুল গাড়ি–ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ—রাজধানীতে একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট, বিভিন্ন জেলায় জমি, ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন এবং বিদেশ ভ্রমণে অবৈধ অর্থ ব্যবহার। একাধিক কর্মকর্তা বলছেন— “মাশফিক সিন্ডিকেট থামানো না গেলে গণপূর্তের সুনাম আর ফিরে পাওয়া যাবে না।”
গণপূর্ত অধিদপ্তর : ভেতরে ক্ষোভ–বাইরে প্রশ্ন—এখন কি বড় ধরনের তদন্ত প্রয়োজন? অভ্যন্তরীণ সৎ কর্মকর্তারা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন— “এখানে এখন কাজ নয়, কমিশনই নিয়ম। উজির আলী আর কাজী মাশফিকের মতোদের প্রভাব বন্ধ না হলে প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাবে। ”গণপূর্ত অধিদপ্তর নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। নতুন সরকারের সামনে তাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ— এই সিন্ডিকেট ভেঙে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও কঠোর তদন্ত নিশ্চিত করা।
