চট্টগ্রাম ইপিজেড এর ছবি (সংগৃহীত)

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার নথি ও মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধান প্রমাণ করেছে—চট্টগ্রাম ইপিজেড (সিইপিজেড) ও কর্ণফুলী ইপিজেড (কেইপিজেড) এখন আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সিন্ডিকেটের দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা কাঁচামাল, পোশাক, জুতা ও মেশিনের যন্ত্রাংশ নিয়মিত পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই অবৈধ কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগের সাবেক ও বর্তমান দোসররা, আর সহযোগিতা দিচ্ছে পুলিশ, কাস্টমস ও বেপজার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। সরকারের রাজস্ব হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা, অথচ বন্দর কর্তৃপক্ষ দায় এড়িয়ে চলছে।

আওয়ামী ফ্যাসিবাদী চক্রের নিয়ন্ত্রণ : অভিযোগ অনুযায়ী পাচার সিন্ডিকেট পরিচালনা করছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাবেক ও বর্তমান প্রভাবশালী নেতা-কর্মীরা। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—জিয়াউল হক সুমন (সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ৩৯নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ)। দেবাশিস পাল দেবু (সাবেক সহসভাপতি, মহানগর যুবলীগ)। মোর্শেদুল ইসলাম তাজু, ব্যবসায়ী। শাহিন চৌধুরী ও শাহেদ চৌধুরী রবিন, আওয়ামী লীগের কর্মী।

এই সিন্ডিকেট ঝুট ও ভাঙারি মালবাহী ট্রাককে ব্যবহার করে কোটি টাকার পণ্য পাচার করছে। এরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিরাপদ থেকে পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেক নেতা বর্তমানে বিদেশে পলাতক, অথচ তাদের নেটওয়ার্ক দেশে সক্রিয়।
প্রশাসনিক যোগসাজশ, পুলিশের ঘুষ ও কাস্টমসের অংশীদারিত্ব : প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, পাচারের প্রতিটি গাড়ি থেকে নির্দিষ্ট হারে টাকা আদায় হয়। পুলিশ, প্রতি ঝুট ট্রাক থেকে ৩০০ টাকা, ভাঙারি ট্রাক থেকে ১০ হাজার টাকা। কাস্টমস কর্মকর্তা, প্রতি ঝুট ট্রাক থেকে ৮০০ টাকা, ভাঙারি ট্রাক থেকে ১৫ হাজার টাকা। বেপজা নিরাপত্তা কর্মী, প্রতি ঝুট ট্রাক থেকে ৩০০ টাকা, ভাঙারি ট্রাক থেকে ৩ হাজার টাকা।
এই টাকা নিয়মিতভাবে ভাগাভাগি হয়, এবং ইপিজেড থানার তৎকালীন ওসির মাধ্যমে পুরো নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, সরকারি কর্মকর্তারা নিজেরাই পাচারের পাহারাদার।

সরকারের রাজস্ব লুট : শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকার পণ্য স্থানীয় বাজারে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে—জাতীয় রাজস্বের ভাণ্ডার ফাঁকা হচ্ছে। বৈধ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হচ্ছে। এভাবে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সিন্ডিকেট শুধু অর্থনীতি নয়, দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট করছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের দায় : বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বেপজার নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বছরের পর বছর ধরে এই অবৈধ বাণিজ্যের অংশীদার। তারা টাকা খেয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে গেটের ওজন না মাপা, গাড়ি না চেক করা এবং সিন্ডিকেটকে সুবিধা দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। জনগণের টাকায় বেতনভুক্ত এরা আসলে পাচারকারীদের পাহারাদার।
প্রমাণিত কারখানার সংশ্লিষ্টতা : অভিযোগে উল্লেখিত কারখানাগুলো হলো—জে জে মিলস, প্রিমিয়ার ১৮৮৮, সেকশন সেভেন অ্যাপারেলস, এমএনসি অ্যাপারেলস, মেরিমো, ক্যান পার্ক, রিজেন্সি, প্যাসিফিক ক্যাজুয়াল, এমজেডএম টেক্সটাইল।এগুলো শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার করে বাজারে অবৈধভাবে পণ্য ছাড়ছে।
সচেতন মহলের সুপারিশ : আওয়ামী ফ্যাসিবাদী চক্রের সিন্ডিকেট সদস্যদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও সম্পদ জব্দ করতে হবে। ইপিজেড থানার পুলিশ, কাস্টমস কর্মকর্তা ও বেপজার দুর্নীতিবাজ কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের ফৌজদারি মামলা দায়ের করা উচিৎ । বন্দর কর্তৃপক্ষের ভূমিকা বিচারিক তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
সব গেটে আধুনিক স্ক্যানার ও ওজন মেশিন বসাতে হবে এবং এই তথ্য সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোল রুমে পাঠাতে হবে।
তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আনতে হবে, যাতে জনগণ জানে—কারা রাষ্ট্রের টাকা লুট করছে।
উপসংহার : চট্টগ্রাম ও কর্ণফুলী ইপিজেড দেশের রপ্তানি আয়ের মূল কেন্দ্র হলেও আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এগুলো এখন পরিণত হয়েছে লুটপাটের কারখানায়। সরকারের ভেতরে-বাইরের এই চক্রকে ভেঙে না ফেললে শুধু রাজস্ব নয়, দেশের অর্থনীতি ও সুনামও ধ্বংস হয়ে যাবে।