
আলোচিত ও সমালোচিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান।

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর দেশের অন্যতম বৃহৎ ও সংবেদনশীল প্রশাসনিক কাঠামো। প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থী, কয়েক লক্ষ শিক্ষক এবং হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও নীতিগত সিদ্ধান্ত এ দপ্তরের ওপর নির্ভরশীল। ফলে এই অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের ভূমিকা কেবল দাপ্তরিক নয়; বরং তা রাষ্ট্রীয় নীতি, সামাজিক আস্থা ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এমন প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান–কে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে যে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ ও প্রচারণা দেখা যাচ্ছে, তা জনস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে অনুসন্ধানযোগ্য হয়ে উঠেছে।
অভিযোগের সূত্রপাত ও বিস্তার : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনির একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হয়। সেখানে মহাপরিচালকের প্রশাসনিক আচরণ, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং একটি নির্দিষ্ট বলয়ের মাধ্যমে দপ্তর পরিচালনার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। যদিও এটি একটি ব্যক্তিগত মতামত, তবে এর সঙ্গে মাঠপর্যায়ের শিক্ষক অসন্তোষ, বদলি–সংক্রান্ত অভিযোগ এবং প্রশাসনিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার প্রসঙ্গ যুক্ত হওয়ায় বিষয়টি কেবল ব্যক্তিগত বক্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।

মাঠপর্যায়ের একাধিক শিক্ষক নেতা ও জেলা–উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, বদলি, পদায়ন, প্রশিক্ষণ মনোনয়ন কিংবা প্রশাসনিক সুবিধার ক্ষেত্রে একটি অনানুষ্ঠানিক মধ্যস্থতাকারী বলয়ের অস্তিত্ব রয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, অনেক সিদ্ধান্ত লিখিত নথির পরিবর্তে মৌখিক নির্দেশনার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে—যা প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে।

আন্দোলন ও অসন্তোষের প্রতিফলন : গত কয়েক মাসে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় প্রাথমিক শিক্ষকদের একাধিক কর্মসূচি ও আন্দোলন হয়েছে। এসব কর্মসূচিতে অন্যায্য বদলি, পদোন্নতিতে অনিয়ম এবং প্রশাসনিক হয়রানির অভিযোগ উঠে আসে। আন্দোলনকারীদের একটি অংশ সরাসরি মহাপরিচালকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সরকারি কর্মচারী বিধির কারণে অনেকেই প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন।
একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জরুরি বিষয়েও মহাপরিচালকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয় এবং মধ্যস্ততাকারীর ওপর নির্ভরতা বাড়ে—যা প্রশাসনিক শৃঙ্খলার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

পাল্টা প্রচারণা ও প্রশংসামূলক প্রতিবেদন : অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও পত্রিকায় মহাপরিচালকের পক্ষে প্রশংসামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে—তার বিরুদ্ধে প্রকাশিত অভিযোগগুলো “মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” এবং কিছু অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের অনিয়ম আড়াল করতেই এ ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছেন। ওই প্রতিবেদনগুলোতে মহাপরিচালকের যোগদানের পর অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নতুন ভবন নির্মাণ, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং তার ব্যক্তিগত সততা ও সহজলভ্যতার প্রশংসা করা হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব প্রতিবেদনের অধিকাংশই একই ভাষা ও বর্ণনার পুনরাবৃত্তি করেছে, যা সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ও উৎসের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
মূল প্রশ্ন: তদন্ত কোথায় ? এই পুরো বিতর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের অনুপস্থিতি। এখন পর্যন্ত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুদক বা অন্য কোনো দায়িত্বশীল সংস্থা থেকে প্রকাশ্য তদন্তের ঘোষণা পাওয়া যায়নি। মহাপরিচালকের পক্ষ থেকেও অভিযোগগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বা নথিভিত্তিক জবাব সামনে আসেনি।
একজন সাবেক শিক্ষা সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এ ধরনের অভিযোগ প্রকাশ্যে এলে সরকারের উচিত নিরপেক্ষ তদন্ত করা। অভিযোগ মিথ্যা হলে তাতেই কর্মকর্তার সম্মান রক্ষা পাবে, আর সত্য হলে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে। নীরবতা সবসময় সন্দেহ বাড়ায়।”
উপসংহার : এই অনুসন্ধানে একটি বিষয় স্পষ্ট—প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ঘিরে অভিযোগ, পাল্টা প্রচারণা ও নীরবতার একটি জটিল চক্র তৈরি হয়েছে। সব অভিযোগ যে সত্য, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না; আবার সব অভিযোগ যে ভিত্তিহীন, তাও বলা কঠিন। কিন্তু একটি রাষ্ট্রীয় দপ্তরের প্রধানকে ঘিরে যদি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, যোগাযোগহীনতা ও সম্ভাব্য অনিয়মের প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে, তাহলে তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। প্রাথমিক শিক্ষা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভিত্তি। সেই ভিত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যদি আস্থার সংকট তৈরি হয়, তার প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্র—উভয় ক্ষেত্রেই গভীর হবে। তাই ব্যক্তি নয়, প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও নিরপেক্ষ তদন্তই হওয়া উচিত এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
