কোয়ারেন্টাইনে বিএনপি!

এইমাত্র রাজনীতি

নীরব নীতিনির্ধারকরা

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বিশেষ পরিস্থিতিতে সারা দেশে দলের তৃণমূল ও মধ্যম সারির নেতাদের উদ্যোগে অব্যাহতভাবে ত্রাণ তৎপরতা ও সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করা হলেও বিএনপির নীতিনির্ধারণী ও সিনিয়র নেতারা অনেকটাই আড়ালে রয়েছেন। নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় ব্যক্তিগত তহবিল থেকে সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করলেও করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে ‘রাজনৈতিকভাবে’ নিষ্ক্রিয় রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ অধিকাংশ নেতা। নীতিনির্ধারকদের এই নীরবতাকে ‘অপব্যাখ্যাজনিত নীরবতা’ হিসেবে দেখছেন দলের অন্যান্য নেতা। আর নীতিনির্ধারকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও এরপরের পরিস্থিতি নিয়ে প্রেডিক্ট বা ধারণা করার সুযোগ নেই। তবে তারা পুরো পরিস্থিতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কী কী উদ্যোগ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছেন।
বিএনপির গত এক মাসের রাজনৈতিক তৎপরতা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও করোনাভাইরাসের বর্তমান সময় ও পরবর্তী সময় নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কোনও আলোচনা হয়নি। এমনকি অন্যান্য রাজনৈতিক দল ইন্টারনেটের মাধ্যমে দলীয় বৈঠক ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করলেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা রয়েছেন একেবারেই চুপচাপ। এরমধ্যে দলীয় রাজনৈতিক অবস্থান কেবল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তুলে ধরেছেন তিনবার। গত ৪ এপ্রিল তিনি ৮৭ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব দেন সরকারকে। সেদিনই বিকালে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তা প্রত্যাখ্যান করলেও পরদিন (৫এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রীর তরফে বিশেষ তহবিল গঠনে সরকার ‘জনমতকে গুরুত্ব দিলেও তাতে শুভঙ্করের ফাঁকি’ রয়েছে বলে একই দিন (৫এপ্রিল) প্রতিক্রিয়া জানান মির্জা ফখরুল। ৮ এপ্রিল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মুক্তি দিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে চিঠি দেন বিএনপি মহাসচিব। তিন দফায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ৯৫ হাজার ৬৯১ কোটির টাকার অর্থনৈতিক প্যাকেজ সম্পর্কে ১৭ এপ্রিল বিএনপি মহাসচিব বলেন ‘এই প্যাকেজ কোনও অনুদান নয়, ঋণনির্ভর প্যাকেজ।’ সেদিন ফখরুল জাতীয় টাস্কফোর্স গঠনের দাবি জানালেও ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনও সাড়া পায়নি বিএনপি। সবশেষে ২৫এপ্রিল গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, সরকারের একলা চলো নীতির কারণেই জনগণ করোনাভাইরাসের প্রচ- ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ৪এপ্রিল, ১৭এপ্রিল ও ২৫এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে কথা বললেও স্থায়ী কমিটির অন্য নেতারা ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন (১৪এপ্রিল) ও স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (১৫এপ্রিল) একবার করে ভিডিওতে বক্তব্য রেখেছেন।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, করোনাভাইরাস বাংলাদেশে সংক্রমণের পর থেকে তারেক রহমানের নির্দেশনাতেই দল পরিচালিত হচ্ছে। তার সিদ্ধান্তেই দলের সাংগঠনিক গঠন ও পুনর্গঠন কার্যক্রম আগামী ২৫ মে পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে সারা দেশে যে ত্রাণ তৎপরতা চলছে, তাতেও সরাসরি তার দিকনির্দেশনা রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নীতিনির্ধারণী ও সিনিয়র পর্যায়ের নেতারা। করোনা সংক্রমণের পর সর্বদলীয় উদ্যোগের ভিত্তিতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থাকলেও বিএনপি নেতারা বিষয়টিকে আর এগিয়ে নেননি। অনেকটা নিজেদের সঙ্গে দলীয় রাজনীতিকেও কোয়ারেন্টিনে আবদ্ধ রেখেছেন তারা। ১৩ এপ্রিল বাম গণতান্ত্রিক জোটের সর্বদলীয় অনলাইন বৈঠকে দলের মহাসচিব যোগ দিলেও সেই সভা থেকে কার্যকর কোনও পথের সন্ধান করেনি বিএনপি।
দলের নীতিনির্ধারকদের এই নীরবতার পেছনে সরকারের প্রভাব দেখছেন বিএনপির সিনিয়র পর্যায়ের একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিএনপি শুরু থেকে করোনাভাইরাস নিয়ে অবস্থান ব্যক্ত করেছে। কিন্তু যত সময় গেছে, বিষয়টিকে তত দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছে ক্ষমতাসীন দল। বিশেষ করে বিএনপির কোনও বক্তব্যকেই সহজভাবে না নিয়ে অপব্যাখ্যা করেছেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তি। সরকার চায় আমরা বিষয়টাকে কন্ট্রোভার্সিয়াল করে ফেলি। এখন করোনা মোকাবিলা করা উচিত, ব্যক্তিগত রাজনীতি করতে চাই না। কোনও নেতিবাচক কথাও বলতে চাই না।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গত ৪ এপ্রিল সরকারকে যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রস্তাব করে বিএনপি, সেই প্রস্তাবের মূল ড্রাফট করেছেন মির্জা ফখরুল স্বয়ং। তার সেই ড্রাফটের পথ ধরেই দলের ও শুভানুধ্যায়ী পর্যায়ের কয়েকজন এক্সপার্ট সেই পরিকল্পনা বিস্তারিত তৈরি করেন। যদিও এরপর করোনাভাইরাসের কারণে বিশেষ পরিস্থিতি এবং পরিস্থিতি উত্তরণে আগামী দিনের ভূমিকা নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের কেউই সক্রিয় নন। যদিও স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই বিগত সময়ে কোনও না কোনও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। সূত্রের দাবি, করোনা নিয়ে পুরো পরিস্থিতি স্টাডি করতে পার্ট পার্ট করে নেতাদের কাজের সুযোগ ছিল, কিন্তু তা হয়নি। এমনকি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট নিয়েও রাজনৈতিক কোনও অবস্থান ব্যক্ত করেনি দলটি।
দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, দলীয়ভাবে আমাদের বিষয়ভিত্তিক কাজ চলছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে আমরা সারা দেশে ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে অপব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে বিএনপি কিছু করছে না। আমরা শুরু থেকেই জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করার কথা বলে এসেছি। সর্বদলীয় ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস করা সম্ভব হলে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা যেমন সহজ হতো, তেমনই বিশ্বশক্তি উপলব্ধি করতো, আমাদের দেশে রাজনৈতিকভাবে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এককভাবে কার্যক্রম করতে চায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারও তা-ই মনে করেন। তার ভাষ্য—‘সরকার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এক্সক্লুসিভলি করতে চায়। সাবেক এই স্পিকার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে পরিস্থিতির সমাধান হোক, তা চান না। ফলে এই মহামারিকালেও তিনি একাই সব করতে চাচ্ছেন। বিএনপি নিজেদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অসহায় ও দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, করোনাভাইরাস যদি কয়েক মাস এভাবে চলে, বর্তমানে ওয়ার্ল্ড অর্ডার যেটা আছে, সেটা একেবারে ওলটপালট হয়ে যাবে। কী ধরনের পরিস্থিতি, কীভাবে হবে, নতুন কী পোলারাইজেশন হবে, তা বলা খুব মুশকিল। এটা প্রেডিক্ট করা সম্ভব না। আমরা চেষ্টা করছি গরিব মানুষের সঙ্গে থাকতে। দলের সর্বস্তরে এ নির্দেশনা দেওয়া আছে। সবাই জানে আওয়ামী লীগ সবাইকে ত্রাণ দিচ্ছে না, এটাকে তারা চুরি করার উৎসব হিসেবে নিয়েছে। সাবেক এই আইনমন্ত্রী আরও বলেন, বাড়ি থেকেই তো বেরোতে পারছি না। সুযোগটা কোথায়, বলে প্রশ্ন করেন মওদুদ আহমদ। তিনি বলেন, আমাদের দলের অবস্থান তো মহাসচিব যতটুকু পারছেন বলছেন। কিন্তু আমাদের পক্ষে তো বাইরে গিয়ে কোথাও সভা করা, আলোচনা সভা সম্ভব না। আর পরের পরিস্থিতি নিয়ে প্রেডিক্ট করা অসম্ভব। এটা কারও পক্ষে বলা সম্ভব না।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইঙ্গিত দিয়েছেন, করোনা সংক্রমণের পর বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে নীতিগতভাবে পরিস্থিতি মূল্যায়নে একটি সমন্বিত উদ্যোগের চেষ্টা করা হবে। এক্ষেত্রে অন্যান্য রাজনৈতিক দলকেও যুক্ত করা যায় কিনা, তাও দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টিতে আনা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, করোনাভাইরাসের যে সংকট চলছে, তা কখন স্বাভাবিক হবে—এটা তো বলা যায় না। ফলে আমাদের পরবর্তী করণীয় কী হবে, সেটা তো এখন বলা যাচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগের মতোই দলের সাংগঠনিক কাজ চলবে। তখন বৈঠক করে পরবর্তী করণীয়ও ঠিক করা হবে। নিজ বাসায় অবস্থান করছেন উল্লেখ করে খন্দকার মোশাররফ বলেন, বাসাতে আছি। আল্লাহ ভালো রাখছেন। দলের অন্য সিনিয়র নেতারাও বাসায় থেকে যার যার কাজ করছেন। এছাড়া, সারা দেশে তো দলের ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।


বিজ্ঞাপন