
নিজস্ব প্রতিবেদক : জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তবিবুর রহমান তালুকদার আবারও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। একের পর এক বড় প্রকল্পের দায়িত্ব পেয়ে যেন তিনি পরিণত হয়েছেন ক্ষমতার একচ্ছত্র প্রতীকে।

বিশ্বব্যাংক অর্থায়িত ‘মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি প্রকল্প’-এর (মূল্য ১,৮৮২ কোটি টাকা) আলোচিত প্রকল্প পরিচালক ছিলেন তবিবুর। প্রকল্পটিতে ভয়াবহ দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগে যখন পুরো অধিদপ্তর তোলপাড়, তখনই গত ৩০ সেপ্টেম্বর তাকে আরও একটি নতুন প্রকল্পের পিডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নতুন প্রকল্পটির বাজেট ১,৯৮৯ কোটি টাকা। ফলে একই কর্মকর্তার হাতে এখন ৩,৮৭১ কোটি টাকার দুইটি বিশাল প্রকল্পের দায়িত্ব।
এই অভূতপূর্ব সিদ্ধান্তে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ভেতরে–বাইরে চলছে তীব্র সমালোচনা ও প্রশ্নের ঝড়—“তবিবুর রহমানই কি এখন ডিপিএইচইর অঘোষিত ‘সুপার বস’?”

‘১০ কোটি টাকা দিয়ে পিডি হয়েছি’ — তবিবুরের ঘনিষ্ঠদের দাবি : অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র বলছে, তবিবুর রহমান ঘনিষ্ঠ মহলে দাবি করেছেন—গ্রামীণ স্যানিটেশন প্রকল্পের পিডি হওয়ার জন্য তাকে ‘১০ কোটি টাকা খরচ’ করতে হয়েছে। এই অর্থ নাকি গিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী এক চক্রের পকেটে।

তবিবুরের ঘনিষ্ঠদের দাবি, এবার তিনি প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার জন্য ১৫ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার দৌড়ঝাঁপে নেমেছেন। এতে সফল হলে তিনি জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে ২৪ জন কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে শীর্ষ পদে বসার নজির সৃষ্টি করবেন।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, “এটা শুধুই দুর্নীতি নয়, এটা প্রশাসনিক নৈতিকতার ভয়াবহ ধ্বংস।”
দুদকের অনুসন্ধানেও প্রভাব খাটানোর অভিযোগ :‘ মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পে’ কাজের অতিরিক্ত বিল, অদৃশ্য ব্যয়ের নামে কোটি কোটি টাকার লেনদেন এবং কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করেছে। তবে অভিযোগ রয়েছে—তবিবুর রহমান তার প্রভাব খাটিয়ে দুদকের একাংশকেও ‘ম্যানেজ করার চেষ্টা’ করছেন।
অধিদপ্তরের ভেতরে এ নিয়ে চলছে আতঙ্ক। অনেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, “যার পেছনে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের ছায়া ও রাজনৈতিক লবিং, তার বিরুদ্ধে কথা বলা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা।”
নেপথ্যে ‘বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ’? : মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্রের দাবি, তবিবুর রহমান আওয়ামী ঘরানার বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের সক্রিয় সদস্য।
জুলাই বিপ্লবের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকর্তারাও নাকি তাকে এখনো ‘বিশেষ সুরক্ষা বলয়ে’ রেখেছেন।
সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হলো—ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসেবেও পরিচিত থাকা সত্ত্বেও তিনি এখন ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও আশীর্বাদ পাচ্ছেন।
এতে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন— “এই প্রভাবের নেপথ্যে কি শুধুই রাজনৈতিক যোগাযোগ, নাকি অন্য কোনো মধু?”
তবিবুরের প্রতিক্রিয়া : যোগাযোগ করা হলে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তবিবুর রহমান তালুকদার বলেন, “পিডি নিয়োগের জন্য যারা নাম প্রস্তাব করেছেন, এরপর যারা নিয়োগ দিয়েছেন, তাদের জিজ্ঞাসা করেন। এসব এখন অতীত।”
তবে তার এই সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া আরও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে—কেন তিনি সরাসরি অভিযোগ অস্বীকার করলেন না?
বিশ্লেষণ : জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ইতিহাসে একই ব্যক্তির হাতে এত বড় দুইটি প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়ার নজির নেই। মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, এর ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং মান নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে।
একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মন্তব্য করেন, “যখন পদের চেয়ে প্রভাব বড় হয়ে যায়, তখন প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়। তবিবুর রহমানের ঘটনাটি তারই প্রতিচ্ছবি।”
সর্বশেষ প্রশ্ন : তবিবুর রহমান কি শুধুই একজন প্রভাবশালী প্রকৌশলী, নাকি কোনো অদৃশ্য শক্তির প্রতিনিধি?
উত্তর হয়তো সময়ই বলবে।
