মহামারিতে বছর পার

এইমাত্র জাতীয়

নিজস্ব প্রতিবেদক : গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটে। এরপরই এই অদৃশ্য মানবশত্রুর বিরুদ্ধে গোটা বিশ্ব লড়াইয়ে নেমে পড়ে। চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্বের প্রতিটি দেশ সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করে। সীমান্তে ও বিমানবন্দরে সতর্কতা জারিসহ বাংলাদেশ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে প্রথম দুই মাস করোনা ভাইরাস ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। ফলে বছরজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বিশ্ব পার করল আরও একটি বছর।


বিজ্ঞাপন

দেশে প্রথম গত ৮ মার্চ করোনা রোগী পাওয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ওই দিন থেকেই গণপরিবহন, দোকানপাট ও কলকারখানা বন্ধ রাখা হয়। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয় ১৭ মার্চ। লকডাউনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করে সরকার। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ নানাবিধ বিধি-নিষেধের মধ্য দিয়ে অফিস-আদালত খুললেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কয়েক ধাপে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সর্বশেষ বন্ধ ঘোষণা করা হয় আগামী বছরের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত।

২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটও প্রণয়ন করা হয় করোনা পরিস্থিতিকে সামনে রেখে। নিরাপত্তা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাঠে সক্রিয়ভাবে কাজ করে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দীর্ঘ ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর গত ৩১ মে থেকে শর্তসাপেক্ষে খুলছে সরকারি-বেসরকারি অফিস।

মহামারিতে ৬৬ দিনের দীর্ঘতম ছুটি: চলতি বছরটিই ছিল টানা দীর্ঘতম ছুটির বছর। মহামারির কারণে চলতি বছর ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন ছুটি থাকে। করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেলে ২৩ মার্চ সচিবালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেন। পরে বন্ধ করে দেয়া হয় সব ধরনের গণপরিবহনও। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় দফায় দফায় ছুটি বাড়তে থাকে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা এবং সাধারণ মানুষের জীবিকার কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন শর্ত পালন ও নির্দেশনা মানা সাপেক্ষে আবার ৩১ মে থেকে অফিস খুলে দেয় সরকার। ধীরে ধীরে খুলে দেয়া হয় গণপরিবহনও।

করোনাকালে আলোচনায় স্বাস্থ্য খাত: গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটার পর পরই সবার দৃষ্টি পড়ে স্বাস্থ্য খাতের ওপর। দেশে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার পুরো দায়িত্ব পড়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওপর। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে দেয়া হয় এর সমন্বয়ের দায়িত্ব।

করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার যখন ব্যস্ত তখন করোনা পরীক্ষা, এন-৯৫ মাস্ক নিয়ে ও স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদি নিয়ে একের পর কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামকে সরিয়ে দেয়া হয়। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে গত ৩০ জুন তাকে বদলি করে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব করা হয়। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে নতুন সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুল মান্নানকে।

গত মার্চে দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একের পর এক কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ পেলে বিপাকে পড়েন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। চিকিৎসকদের নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ দিয়ে কেলেঙ্কারির শুরু। এরপর রিজেন্ট হাসপাতাল, জেকেজি হেলথ কেয়ারের জালিয়াতি ফাঁস হওয়ার পর তোপের মুখে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে তিনি রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সরকারের চুক্তির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দিকে অভিযোগ তুলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিরোধে জড়ান। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দিয়েছিল। গত ২১ জুলাই তিনি পদত্যাগ করেন। ২৪ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) পদে নিয়োগ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়।

এদিকে করোনা ভাইরাসের নতুন একটি পরিবর্তিত রূপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার খবরে সারা বিশ্বে আবারও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। ৭০ গুণ বেশি সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন ভাইরাসটি প্রথম চিহ্নিত হয়েছে যুক্তরাজ্যে। এরপর থেকেই আশপাশের অনেক দেশেই ভাইরাসটি নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। খুব দ্রুত নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, আগের মতোই কভিডের পরিবর্তিত রূপটি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এখনই সতর্ক না হলে এর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

বিশ্বে করোনা ভাইরাসে শনাক্ত রোগী ৮ কোটি ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা অতিক্রম করেছে ১৮ লাখ। ভ্যাকসিন যখন মহামারি মুক্তির আশা জাগাতে শুরু করেছিল, ঠিক সে সময়ে নতুন ধাক্কা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। করোনার প্রথম দিকের সংক্রমণের সময় সারা বিশ্বই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ করে কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনার নতুন রূপটি যুক্তরাজ্যে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে ৪০টিরও বেশি দেশ যুক্তরাজ্যের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ব্রিটেন ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসেও এ ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায়ও করোনা ভাইরাসের প্রায় একই ধরনের আরেকটি রূপ পাওয়া গেছে। এতে যে মিউটেশন ঘটেছে, তা কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের ধরনটির মতোই। দক্ষিণ আফ্রিকার ল্যাবে এখন যেসব ভাইরাসের জেনেটিক অ্যানালাইসিস হচ্ছে, ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ওই বদলে যাওয়া রূপটিরই দেখা মিলছে।

বিজ্ঞানীরা নতুন করোনা ভাইরাসের এ রূপবদল নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, রূপান্তরিত এ ভাইরাস শিশুদের মধ্যে সহজে ও উচ্চহারে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটির নতুন ধরন এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। তবে এটি নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এ অবস্থার কারণে ইউরোপ-আমেরিকার শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ৪০টি দেশের বিমান চলাচল স্থগিত করা হয়েছে। সাবধানতার অংশ হিসেবে আন্তসীমান্ত বন্ধ করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, কুয়েত ও ওমান। আর করোনার নতুন স্ট্রেনের (প্রজাতি) প্রতিষেধক তৈরি করতে মাত্র ৬ সপ্তাহ সময় লাগবে বলে দাবি করেছে জার্মান সংস্থা বায়োএনটেক।

যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ৪০ দেশের বিমান চলাচল স্থগিত: জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম, আয়ারল্যান্ড, তুরস্ক, কানাডাসহ বিশ্বের অন্তত ৪০টি দেশ এ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিমান চলাচল সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। এতে ব্রিটেনের সঙ্গে ইউরোপসহ অনেক অঞ্চলের যোগাযোগ দৃশ্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ব্রিটেনেরে সঙ্গে ভারতও যুক্তরাজ্য থেকে আসা বিমানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশের জন্য একটি স্বাস্থ্য প্রটোকল তৈরি করার কাজ চলছে। যাতে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইউরোপের যান চলাচল আবার শুরু হতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইইউ জোট ছাড়ার ১০ দিন আগেই রূপান্তরিত করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে রোববার মধ্যরাত থেকে আয়ারল্যান্ড, হল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়াসহ আরও কিছু দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ ঘোষণা করেছে।

স্থানীয় সময় সোমবার রাত ১১টা থেকে ফ্রান্স ৪৮ ঘণ্টার জন্য ব্রিটেনের সঙ্গে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। ফলে ব্রিটেনের ইংলিশ চ্যানেলের তীরবর্তী ডোভারের ফেরি ও টানেল দিয়ে পার হওয়া সব গাড়ি ও ট্রাক ফ্রান্সে ঢোকা বন্ধ হয়ে যায়। এতে দুই প্রান্তেই অসংখ্য যানবাহন দীর্ঘ লাইনে আটকা পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে পণ্য পরিবহন।

শিশুদের সহজে আক্রান্ত করতে পারে: যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় নতুন বৈশিষ্ট্যের করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের তথ্য বিশ্লেষণ করেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, রূপান্তরিত এ ভাইরাস শিশুদের অনেক সহজে আক্রান্ত করতে পারে। আগে বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার হার ছিল খুবই কম। তবে নতুন বৈশিষ্ট্যের ভাইরাসটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি উচ্চহারে শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে।